আবহাওয়া দক্ষিণবঙ্গ শিক্ষা লাইফ স্টাইল স্বাস্থ্য ভ্রমন ধর্ম কৃষি কাজ ক্রাইম

বর্ধমান রাজবাড়ির পতনের কারন ? খন্ড -২

krishna Saha

Published :

WhatsApp Channel Join Now

(আজ দ্বিতীয় খণ্ড)

ঘনশ্যাম রায়ের মৃত্যুর পর তার পুত্র “কৃষ্ণরাম রায়” (১৬৭৫-১৬৯৬) রাজকীয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন ! তিনি পরগণা সেনপাহাড়ি অধিগ্রহণ করেন ১৬৮৯ সালে ! রাজত্বের ৩৮ তম বছরে খুশি হয়ে মুঘল সম্রাট ঔরাঙ্গজেব ফরমানে সম্মানিত করেন ! ১৬৯৬ সালে তার রাজত্বকালে শোভা সিংহ, চিতুয়া ও তৎকালীন মেদিনীপুরের বরদার জমিদার তৎকালীন বর্ধমান মহারাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ দাবি করেন এবং আফগান প্রধান রহিম খানের সহায়তায় বর্ধমান রাজপরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন ! বেতাজ ঐক্যবদ্ধ বাহিনী বর্ধমান আক্রমণ করে ও যুদ্ধে কৃষ্ণরাম কে হত্যা করে এবং পরিবারের সকল সদস্যদের বন্দী করে !

আরো পড়ুন – বর্ধমান রাজবাড়ির পতনের কারন ? খন্ড -১

তার পুত্র “জগৎ রাম রাই” তদানীন্তন গভর্নরের সাহায্য নিয়ে কোনোভাবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন ! পরবর্তীকালে “শোভা সিংহ” কে সুযোগে পেয়ে কৃষ্ণরাম রাইয়ের কন্যা “রাজ কুমারী সত্যবতী” হত্যা করেন ! “শোভা সিংহের” মৃত্যুর পর বিদ্রোহীরা দিশাহারা হয়ে আফগান প্রধান “রহিম খানকে” তাদের প্রধান সর্দ্দার নির্বাচিত করে ! সিংহাসনে বসেই বিদ্রোহ এতটাই তীব্রতা পায় যে সম্রাট তাঁর নিজের নাতি “আজিম-উ-শানকে” বাংলা বিহার উড়িষ্যার সরকারের দায়িত্ব দেন ! নবাবের পুত্র “জবরদুস্ত খান” ধারাবাহিক সফল আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের বর্ধমানে ফিরিয়ে আনেন ! অবশেষে শহরের বাইরে আজিম-উ-শানের কাছে পরাজিত হয় এবং তাদের নেতা রহিম খান নিহত হন !

এইদিকে জগৎ রাম রাইয়ের দুই ছেলের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র “কীর্তি চাঁদ রায়” ১৭০২-১৭৪০ উত্তরাধিকারসূত্রে পৈতৃক জমিদারি পেয়েছিলেন ! তিনি চিতুয়া, ভুরশুট, বরদা এবং মনোহরশাহী পরগণা পুনরায় অধিগ্রহণ করেন এবং জমিদারি অধিক বৃদ্ধি করেন ! কীর্তি চাঁদ বুদ্ধিমত্তায় দুঃসাহসিক এবং সফল ব্যক্তি ছিলেন !তিনি মেদিনীপুর জেলা অন্তর্গত ঘাটালের কাছে “চন্দ্রকোনা” ও “বরদা” রাজাদের সাথে যুদ্ধ করেন এবং তাদের রাজ্য দখল করেন ! এর সাথে সাথে হুগলি জেলার তারকেশ্বরের কাছে অবস্থিত “বলঘড়ার” সম্পত্তিও দখল করেন ! তারপর মুর্শিদাবাদে গিয়ে জমিদারি সম্পত্তির এলাকা বৃদ্ধির মালিক হিসেবে নিজের নাম নথিভুক্ত করেন !

See also  কয়লা বোঝাই মালগাড়ি লাইনচ্যুত: স্থানীয় বাসিন্দাদের ভোগান্তি, রেল চলাচলে সামান্য প্রভাব

সাহসী কীর্তি চাঁদের দুঃসাহসিক কৃতিত্ব হলো, তার আক্রমণে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর রাজ্যের শক্তিশালী রাজাকে পরাজিত করা ! মহারাজা কীর্তি চাঁদ ১৭৪০ সালে মারা যান ! ১৭৪০ সালে “চিত্র সেন রায়ের” অভিষেক হয় এবং মন্ডলঘাট, আড়শা এবং চন্দ্রকোনা পরগনাগুলিকে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তিতে যুক্ত করেন ! তিনিই প্রথম দিল্লির সম্রাট কর্তৃক রাজা উপাধিতে ভূষিত হন !

১৭৪৪ সালে “মহারাজ চিত্রা সেন রায়ের” আকস্মিক মৃত্যু হয় ! এরপর ১৭৪৪ সালে ভাই “তিলক চাঁদ রায়ের” রাজ্যাভিষেক হয় ! সম্রাট “আহমদ শাহ” তার রাজত্বের অধিকার নিশ্চিত করেন ও ফরমান দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন ! পরবর্তীকালে বিপুল অর্থ দিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিলেন !

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের তিন বছর পর ১৭৬০ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলাসহ বর্ধমানের জমিদারি বাংলার গভর্নর নবাব “মীর মুহাম্মদ কাশিম খান” ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করেন ! তখন বর্ধমানের আয়তন ছিল প্রায় ৫১৭৪ বর্গমাইল এবং এটি বাংলার সুবাহের সবচেয়ে উৎপাদনশীল জেলা হিসেবে বিবেচিত হত ! বিদ্রোহের আগুনে দেশ সেইমূহুর্তে অস্থির অবস্থায় ছিল এবং ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি অধিগ্রহণকে ততটা লাভজনক মনে করেনি !

১৭৭০ সালে “তিলক চাঁদ রায়” মারা যান, তখন পুত্র তেজ চাঁদ রায়ের বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর ! তার মা মহারাণী বিষ্টু কুমারী দেওয়ান “রূপ নারায়ণ চৌধুরীর” সহায়তায় এস্টেট পরিচালনা করেন !১৭৭৯ সাল থেকে “তেজ চাঁদ বাহাদুর” নিজে এস্টেট পরিচালনা শুরু করেন !মহারাজা তেজ চাঁদের পুত্র “প্রতাপ চাঁদ” পিতার জীবদ্দশায় নিখোঁজ হয়ে যায় !


দীর্ঘ কয়েক বছর পর একজন “প্রতাপ চাঁদের” দাবি নিয়ে হাজির হন রাজ পরিবারে ! অনুসন্ধান তদন্ত ছাড়াই দেওয়ানী আদালত কর্তৃক বিষয়টি খারিজ হয়ে যায় ! ১৮৩২ সালে মহারাজ “তেজ চন্দ্র” মারা যান ! তিনি দত্তক পুত্র মাহতাব চাঁদ (চুনি লাল কাপুর) এবং তার বিশাল জমিদারি ও ধনসম্পত্তি রেখে যান !

বিজয় চাঁদ মাহতাব তার পূর্বসূরি মহারাজা আফতাব চাঁদ মাহতাব উত্তরাধিকারী ছাড়াই মারা যান ! তার বর্ধমান এস্টেটের অতীত শাসক মাহতাব চাঁদ বাহাদুরের আত্মীয় “বন বিহারী কাপুরের” শিশুপুত্র “বিজয় চাঁদ মাহতাবকে” ১৮৮৭ সালে দত্তক নেন !বন বিহারী ১৯০২ সাল পর্যন্ত এস্টেট শাসন করেছিলেন !
কোম্পানি ১৮৯৩ সালে বন বিহারী কাপুরকে ‘রাজা’ উপাধি দেন !১৮৯৭ সালে বর্ধমানের রাজাকে ৬০০ জনের একটি সশস্ত্র বাহিনী এবং ৪১ টি কামান বজায় রাখার অনুমতি দেয় !

See also  তৃণমূলে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আসলে কৌশল ; শুভেন্দু

১৮৯৯ সালে বিজয় চাঁদ মাহতাব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং রাজ পরিবারের মধ্যে তিনিই প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করেন ! ১৯০২ সালে তিনি বর্ধমান রাজসিংহাসনে সম্পূর্ণ শাসক ক্ষমতার অধিকারী হন ! 1903 সালে দিল্লি দরবারে তাকে “রাজাধিরাজ” উপাধি দেওয়া হয় !

বিলাসবহুল বর্ধমান রাজ্প্রাসাদে একটি আড়ম্বরপূর্ণ রাজ্যাভিষেকের আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে “লেফটেন্যান্ট গভর্নর বোর্ডিলন” এই সম্মান প্রদানের জন্য উপস্থিত ছিলেন !

১৯০৩ সালে তিনি গভর্নর জেনারেল “লর্ড কার্জনকে” বর্ধমান প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান এবং অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে খুশি করতে “কার্জন গেট” নামে পরিচিত একটি গেট নির্মাণ করেন ! আজ যেটি শহর বর্ধমানের জনপ্রিয় ল্যান্ডমার্ক “বিজয়তোরণ” ! বর্ধমানের রাজপ্রাসাদটি গেট থেকে এক কিমি দূরে অবস্থিত !

১৯০৮ সালে ৭ ই নভেম্বর ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা লেফটেন্যান্ট গভর্নর “স্যার অ্যান্ড্রু ফ্রেজার” কে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল তখন মহারাজা জীবন রক্ষা করেছিলেন ! তারজন্য তাকে দেশদ্রোহী এবং বেঈমান মিরজাফরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল ! তিনি রাজপরিবার ধরে রাখতে ইংরেজদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে চলতেন সেটা স্পষ্ট !

১৯০৮ সালে “লর্ড মিন্টোর” একটি ঘোষণা অনুসারে “মহারাজাধিরাজা” উপাধিতে উন্নীত হয়ে ধারাবাহিকভাবে আইন ও প্রাদেশিক পরিষদে বাংলার জমিদারদের প্রতিনিধিত্ব করতে থাকেন ! তার জনহিতকর কাজের জন্যও বিশেষভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কল্যাণের ক্ষেত্রে বিখ্যাত ছিলেন ! বিজয় চাঁদ হাসপাতাল ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন ! ১৯০৭ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য এবং ১৯০৯ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন ! পরবর্তী বছরগুলিতে রাজ্য প্রশাসনের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত বাংলার নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন ! ১৯১১ থেকে ১৯১৮ এবং আবার ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও ছিলেন !

বিজয় চাঁদ মাহতাবের সরকারী সীলমোহর ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য থাকা সত্ত্বেও তিনি ১৯২৫ সালে “মহাত্মা গান্ধীকে” উষ্ণ আতিথেয়তা প্রদান করেছিলেন এবং ১৯২৮ সালে #বর্ধমান পৌরসভা নির্বাচনে# প্রচারের জন্য বর্ধমানে এলে “সুভাষ চন্দ্র বসুকে” আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছিলেন !!

See also  বর্ধমানে হেরোইন কারবারের পর্দা ফাঁসের পর এবার পূর্বস্থলীতে চলা আন্তরাজ্য গাঁজা কারবারের পর্দা ফাঁস করলো এসটিএফ - উদ্ধার ২৬ টি বস্তা সহ ৮২৪ কেজির গাঁজা

আমরাও এখন ২০২২ #বর্ধমান পৌরসভা# নির্বাচনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ! (ক্রমশ)

ARTICLE PUBLISHED BY রথীন রায়

কেমন লাগছে জানান এবং তৃতীয় খন্ডের জন্য ১৪/০১/২২ তারিখে চোখ রাখুন 🙏
আরো পড়ুন – বর্ধমান রাজবাড়ির পতনের কারন ? খন্ড -১

krishna Saha

আমার নাম কৃষ্ণ কুমার সাহা, আমি ফুল টাইম সাংবাদিকতা করি।গত ৮ বছর ধরে এই পেশায় আছি