শ্রীমতী যখন শ্রীমত্যা
সুদীপা ব্যানার্জী
দেবী বরণের সময় যখন মণ্ডপের ভিতরে পাড়ার একদল শ্রীমতীরা সিঁদুর খেলায় মেতেছিল তখন পাড়ার আর একদল শ্রীমত্যারা কপাটের আড়ালে এক চোখ জল নিয়ে মুখ লুকিয়েছিল । কারণ তারা যে so called বিধবা। দেবী বরণের অধিকার এই তথাকথিত আধুনিক শিক্ষিত সমাজ তাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে। শ্রীমতী থেকে শ্রীমত্যা হওয়ার অপরাধে এখন সিঁদুরের বন্ধ কৌটোটাও হাতে নেওয়া পাপ, তাহলে তারা দেবী বরণ করবে কী করে? সমাজ এখন তাদের অপয়া বলে, অলক্ষ্মী বলে । বাদ যায়না একুশ বছরের সদ্য বিধবা মেয়েটাও। যে মেয়েটা গত বছরেও সিঁদুর খেলায় রাঙা হয়ে স্বামীর সোহাগ গায়ে মেখেছিল। স্বামী মারা যাবার পর সেই একুশ বছরের মেয়েটার নাম হলো বিধবা । জীবন থেকে চলে গেল সব রঙ। গায়ে জড়িয়ে নিল সাদা থান ।
আচ্ছা একটা কথা বলুন তো ,এই সাদা থান বিধবাদের কে দিয়েছে ? স্বামীর মৃত্যু ?নাকি এই তথাকথিত সামাজিক ভ্রান্ত প্রথা? তাদের আমিষ খেতে মানা, নিজেদের রঙিন কাপড়ে আর রঙিন টিপে সাজাতে মানা ,গয়না পড়তে মানা,হাসি ঠাট্টা করতে মানা,এমনকী অফিস থেকে রাত করে ফিরলেও সমাজ তাদের গায়ে লেপে দেয় চরিত্রহীনার চুনকালির প্রলেপ।
আর রইল বাকি কিছু শুভ কাজের উদাহরণ – বরণ, আশীর্বাদ, গায়ে হলুদ, বিবাহ, সাধভক্ষণ এই সব কাজেও তাদের যোগ দিতে মানা ।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাদের পায়ে শুধু বিধিনিষেধের বেড়ি। বিধবা মায়ের তার ছেলে-মেয়ের বিয়েতে থাকা নিষেধ, বধূবরণ, জামাই বরণ করতে নিষেধ। বিধবা দিদির তার ভাই-বোনের বিয়েতে ভাইয়ের গায়ে বোনের গায়ে হলুদ লাগাতে নিষেধ ।বিধবা বউদির পাড়ার মণ্ডপে দেবী বরণ নিষেধ, অপয়া হাতে সধবার কপালে সিঁদুর ছোঁয়াতেও নিষেধ।

হিসেবের খাতায় নিষেধের তালিকাটা এতটাই বেশি যে তারা একটা সময়ে সেই নিষেধাজ্ঞাকে বহুমূল্যের প্রাপ্তি মেনেই আশকারা দিয়ে মাথায় তুলে দেয়। তারপর সারাজীবন ভীরুতা নিয়ে নিজেদের চারপাশে নিষেধের বর্ণহীন বেড়াজাল তৈরী করে তাতেই নিজেদের আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রাখে সারাজীবন ।
আর সমাজও তখন দেয় বাহবা । আচ্ছা সত্যিই কী এটাই প্রাপ্য তাদের এই সমাজের কাছ থেকে ? তারা নিজেদের রঙিন সাজে সাজালে আড়ালে চলে কানাকানি আর শুভ কাজে যোগ দিলে মুখ ঝামটা আর চোখ রাঙানি ।
স্বামী থাকলে তারা শ্রীমতী রানী আর স্বামী মারা গেলে শ্রীমত্যা ভিখারিনী ।
তাদের মনে কোনও ইচ্ছে ,কোনও সখ থাকতেই নেই।অতীতের মধুর স্মৃতি গুলো ছাইচাপা দিয়ে সমাজ তাদের দেয় ফিকে বর্তমান ।
তারাও সিঁদুর খেলতো, বরণ করতো,শুভ কাজেও থাকতো।তাদের সেই ইচ্ছে আর আবেগ গুলো ছুটে ছুটে বেরিয়ে আসতে চায় অন্দরমহলের চৌকাঠ পেরিয়ে ।কিন্তু সমাজ তো মানবে না তাদের এই অন্যায় আবদার। আর আইন ? আইন আর সমাজ অনেকটা মহাভারতের অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র এবং কৃত্রিম দৃষ্টিহীনা গান্ধারীর মতো । আমাদের দেশে পরকীয়ার সম্মান আছে কিন্তু শ্রীমত্যার সম্মান নেই। পরকীয়া বৈধ ঘোষিত হলেও বৈধব্যের ভ্রান্ত প্রথা ভাঙার আওয়াজ অঘোষিত। শ্রীমত্যাদের সকল শুভ কাজে যোগ দেবার বৈধতা নেই ।
কিন্তু আর কতকাল এই অপমান মুখ বুজে সহ্য করা সম্ভব? আইন কি চেঁচিয়ে বলে উঠতে পারেনা শ্রীমত্যারা সকল শুভ কাজে যোগ দেবে , রঙিন সাজে সাজবে, আমিষ খাবে । আর সমাজ যদি তাদের চোখ রাঙায় , মন্দ কথা বলে , বাধা দেয় তাহলে শ্রীমত্যারা আইনের প্রশ্রয় নিয়ে এই সমাজের মুখে ছুঁড়ে মারবে অজস্র প্রতিবাদ।
আর শ্রীমত্যাদের উদ্দেশ্য বলি, উন্নত মানব সভ্যতা যখন আধুনিকতার চরম শিখরে পৌঁছেছে তখন কেন মনের মধ্যে বাসা বাঁধে সেকেলে ভ্রান্ত মনোভাব? আধুনিকতার সরলরেখা ধরে হাঁটতে হলে মনটা কুসংস্কারে ভরিয়ে রাখা যাবে না । আমরা তো আর সেই যুগে নেই যখন বাল্য বিধবাদেরও নিস্তার ছিলো না
একাদশীর উপবাসে ঢোঁক গিললেও জুটত ঝাঁটা লাথি।
কাটা হতো বিধবার মাথার চুল আবার কখনো তোলা হতো সহমরণ চিতায়। আমরা যখন সেই যুগে আর পড়ে নেই তখন আধুনিকতার একটা কোণ হোক না মনের সঙ্গী । সংস্কার ভালো কিন্তু কুসংস্কার নয়। তাই মন থেকে দূর হোক কুসংস্কার ।কিসের এই ভীরুতা, শুধুমাত্র পাপের ভয় ? আচ্ছা ভাবুন তো একবার, পাপের ভয়ে নিজেকে বঞ্চিত করে রাখা পাপ নয় ?
তাই আর ভীরুতা নয়, আর দুর্বলতা নয় । শ্রীমত্যা বাঁচুক বুকে সাহস নিয়ে সসম্মানে । সমাজের ভয় , কুসংস্কারের ভয় , পাপের ভয় না করে নিজেদের অধিকারের দাবীতে আন্দোলন করতে হবে নিজেদেরই । সমাজকে দেখাতে হবে চোখ রাঙালেই সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়না । শ্রীমত্যাও হবে রঙিন । যোগ দেবে শুভ কাজে । মনে রাখতে হবে এক বুক কষ্ট নিয়ে ভীরুতা নিয়ে বাঁচার থেকে এক আকাশ প্রতিবাদ নিয়ে মরা অনেক সম্মানের ।
ভীরুতা নয় সাহসিকতাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হোক । ভ্রান্ত নিয়মের আর কুসংস্কারের ক্রীতদাসী না হয়ে সুশিক্ষার আলোকে অভিষিক্তা হয়ে যুগ বদলের রানী হয়ে বাঁচুক সকল শ্রীমত্যা ।