উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়নগর: শীত পড়ে গেছে।জয়নগর ও বকুলতলা থানা এলাকার বিভিন্ন এলাকায় খেজুর গাছ কাটার কাজ চলছে।যা দিয়ে বিশ্ব বিখ্যাত জয়নগর মোয়া তৈরি হচ্ছে।আর সংখ্যালঘু গরীব পরিবারের এক গৃহবধূ সংসারের হাল ধরার জন্য স্বামীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খেজুর গাছে হাড়ি বাঁধছে।তিনিই দক্ষিন ২৪ পরগনা জেলার প্রথম মহিলা শিউলি।মহিলারা পারেনা এমন কোন অসাধ্য সাধন কাজ এ দুনিয়ায় নেই।

দেশের রাস্ট্রপতি একজন মহিলা,রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা। মহিলাদের বীর পরাক্রমের কথা ইতিহাসের পাতা থেকে শুরু করে অপারেশন সিন্দুর পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। স্বামীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংসারের হাল ধরার জন্য জয়নগর বিধানসভার বকুলতলা থানার ময়দা গ্রাম পঞ্চায়েতের খৈয়ামারা গ্রামের গৃহবধূ মাজিদা লস্কর এখন জেলার প্রথম মহিলা শিউলি। সাধারণত শীতের সময় বাঙালি রচনা তৃপ্তিতে নানান পিঠেপুলি খাদ্য তালিকায় রয়েছে। কিন্তু পিঠে পুলি নলেন গুড় ছাড়া যেন অসমাপ্ত। জয়নগরের প্রসিদ্ধ মোয়া তৈরিতেও নলেন গুড়ের অবদান অপরিসীম।

সেই কারণে শীতের সময় খেজুর গাছের এই রস দিয়ে তৈরি হওয়া নলেন গুড়ের চাহিদা থাকে অপরিসীম। সাধারণত এই শীতের সময় খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করার জন্য শিউলিরা খেজুর গাছে হাড়ি বাঁধে। ছোটবেলা থেকে মাজিদার স্বামী আব্দুর রউফ লস্কর এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। বিবাহের পর থেকে সংসারের হাল ধরার জন্য মাজিদা লস্কর ওনার স্বামীর সাথে শিউলির কাজ শুরু করে। বিয়ের পর থেকে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে স্বামীর সাথে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি এখন পুরোপুরি শিউলি হয়ে উঠেছে। তিনি এখন নিজে নিজেই খেজুর গাছের রস সংগ্রহ থেকে শুরু করে রস জ্বাল দিয়ে নলেন গুড় তৈরি করার প্রক্রিয়া পর্যন্ত সিদ্ধহস্ত।

এই দম্পতি মিলে এলাকার প্রায় ২৫০ টি খেজুর গাছ থেকে একদিনে রস সংগ্রহ করে।তিন সন্তান ও বাড়ির কাজ সামলে এই দম্পতি এখন জয়নগর এলাকার প্রসিদ্ধ বেশ কয়েকটি মোয়া দোকানের নলেন গুড়ের সরবরাহে প্রথম সারির শিউলি। জেলার প্রথম মহিলা শিউলি মাজিদা লস্কর বলেন,আমরা খুব গরীব, আমার বাপের বাড়ি বকুলতলা থানার মায়াহাউড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের দেওয়ানের চক গ্রামে।৫ম শ্রেনীর পর আর পড়াশোনা করা হয়নি দারিদ্র্যতার কারনে।এর পরে বিবাহের পর থেকে সংসারের অভাব গোছানোর জন্য স্বামীর সঙ্গে এই কাজে আমি যুক্ত হই। প্রথমের দিকে বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমার। এই কাজ শিখতে গিয়ে বহু আঘাত এবং ব্যথাসহ্য করতে হয়েছে।

খেজুর গাছের কাঁটা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে স্বামীর সঙ্গে এই কাজের সঙ্গে থেকে আমি সমস্ত কিছু শিখেছি।এই শীতের মরশুমে স্বামীর সঙ্গে এই শিউলির কাজ করি সংসার সামলে। দুজনে মিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই কাজ করি।আমরা চাই, আমরা গরীব অসহায় সংখ্যালঘু পরিবারের মানুষ, সরকারি কোনো সহায়তা পাই না।বর্তমানে বয়সের কারনে খেজুর গাছ মরে যাচ্ছে।নতুন করে কেউ এই পেশায় আসতে চাইছে না।আমি একজন মহিলা হয়ে এই শিউলির মতন কস্টের পেশা আকঁড়ে সংসার চালাছি।

তাই সরকারি কিছু সাহায্য পেলে খুব ভালো হয়।এ বিষয়ে ঐ মহিলা শিউলির স্বামী আব্দুর রউফ লস্কর বলেন, ছোটবেলা থেকে এই কাজের সঙ্গে আমি যুক্ত রয়েছি।চার পুরুষ ধরে আমরা শিউলির কাজ করে চলেছি।খুব কস্টের কাজ।আগামী প্রজন্ম আর কেউ এই পেশায় আসতে চাইছে না।যার ফলে আগামী দিনে আসল ভালো মানের নলেন গুড়ের সংকট তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে।তবে এবছর শীতের শুরুটা ভালোই।এক লিটার খেজুরের রসে ভালো মানের ১৫০ গ্রাম নলেন গুড় তৈরি হয়। আমরা দুজনে মিলে এক দিনে ২৫০ টি গাছ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহ করি।

আমার স্ত্রী প্রথম আগ্রহ জানিয়েছিল সে আমার সঙ্গে এই কাজ করবে। এরপর ধীরে ধীরে স্ত্রীকে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত করি। নিজে হাতেই সে গাছ থেকে খেজুর রস সংগ্রহ করে কিভাবে খেজুর রস থেকে নলেন গুড় প্রস্তুত করবে সমস্ত প্রক্রিয়ায় পারদর্শী হয়ে গেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে ধীরে ধীরে এই কাজ শিখে সে এখন পুরোপুরি একজন মহিলা শিউলি হয়ে উঠেছে। ১২ বছর ধরে আমার পাশে থেকে আমাকে সাহায্য করে যাচ্ছে আমার স্ত্রী।
আমার জীবন সংগ্রামের লড়াইয়ে আমার স্ত্রীই অন্যতম যোদ্ধা।এই কাজ অনেক কষ্টসাধ্য কাজ সেই কারণে আগামী প্রজন্ম এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছে না। এই কাজে লাভ অনেক কম যে পরিমানে পরিশ্রম আমরা করি সেই পরিমাণ টাকা আমরা পাই না। এর ফলে আগামী প্রজন্ম এই কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।তবে দক্ষিন ২৪ পরগনা জেলার সর্বপ্রথম মহিলা শিউলি মাজিদা লস্করের এই কঠিন সংগ্রামের সাক্ষী থাকলাম আমরা।








