আবহাওয়া দক্ষিণবঙ্গ শিক্ষা লাইফ স্টাইল স্বাস্থ্য ভ্রমন ধর্ম কৃষি কাজ ক্রাইম

মনের মত খাসির মাংস

krishna Saha

Published :

WhatsApp Channel Join Now

মনের মত খাসির মাংস

পার্থ চৌধুরী

খাসির মাংসে আলু না থাকলে আর খেয়ে লাভ কী! এটাই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া স্বাদকোরকের অনুভূতি।বাবা খাসির মাংস চরম ভালবাসত। জেলখানা মোড়ের বাঁধা মাসকাবারি দোকান ছিল। সেখান থেকে শালপাতার ঠোঙায় মুড়ে হাফ কেজি মাংস আর মাটির ভাড়ে দই মিষ্টি ঝুলিয়ে শনিবার বাবা অফিস থেকে ফিরতো।। অফিস ফেরতা কিছু না কিছু বাজার করে ফেরা ছিল বাবার অভ্যাস। আমরা বলতাম বাবু! অপেক্ষা করতাম বাবু কী নিয়ে ফেরে। ধুতি আর ফুলশার্ট পড়া কালো লম্বা মানুষটা ছাতা আর বাজারের ব্যাগ আর সারা দিনের ক্লান্তি নিয়ে ফিরে আসতো তখন যেন আমাদের নিজস্ব সান্তা ক্লজ। কোনোদিন ইলিশ; কোনোদিন মাগুর মাছ। সংগে মরশুমি ফল; গুড়; মোয়া। নিদেনপক্ষে কোলে বিস্কুট কিংবা লর্ডসের জেলি লজেনস।সার সপ্তাহের ক্লাইম্যাক্স ছিল ওই শনি রবিবার। তখন শনিবার আপিস হত। রোব্বারকে যে উইক এন্ড বলে জানতাম না। ওদিনটা ছিল চুল ছাঁটার দিন আর দুপুরে খাসির মাংস।


আমাদের পরিবারে দুটো জিনিস কমন। বাবাও ছিলেন চরম পেটরোগা। আর পরম ভোজনরসিক।খেয় শরীর ছেড়ে দিলে কারমিনেটিভ মিক্সচার খাও।আবার পরের দিন থেকেই জমিয়ে খাও। সবাই বলত; ‘ আরে সামনে রিটায়ারমেন্ট।কিছু জমাও।একটা জায়গা কেনো। চার চারটে ছেলেমেয়ে তোমার।’
বাবা কর্ণপাত করত না।বলত ; যদ্দিন আছে খেয়ে যাক না!’ আমার সাড়ে এগারো বছর বয়সে বাবা রিটায়ার করে। কিন্তু তার মধ্যে আমি এত পেয়েছি; সারাজীবন আর খাওয়া নিয়ে আফশোস করতে পারার জো নেই! আমার পরের বোন টুকুন; মেজভাই শ্যামল আর একেবারে ছোট জয়ন্ত ওরা
কিছুই তেমন পায়নি।
মনের গতি বিচিত্র। ছোটবেলায় আমার মনে হত বাবা মা মেজভাইকে বেশি ভালবাসে। ছুটির দিনে বাজারে গেলে ভাই মাস্ট। দুজনে মিলে ঘন্টা দুয়েক বাজার বেছে বেছে তবে ফেরা।বড় হয়ে বুঝেছি; ওটা ছোটবেলার অভিমান। ভরসা করার কারণ ছিল বৈকি!

See also  খণ্ডঘোষ ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সেদিন ডাক্তারদের সংবর্ধনা জ্ঞাপন


এই দেখুন মনের গতি! কোথা থেকে কী! হচ্ছিল খাসির মাংসের কথা। তা নয় কীসব আলিংঝালিং।
যাই হোক শনিবারের ওই খাসির মাংস কষিয়ে রাখা হত। রবিবার মা আলু দিয়ে ঝোল রাঁধত। ওই একখানা ছোট্ট ঘরের পাশে প্রায়ান্ধকার একখালি জায়গা। ওই পাকশালে বসে মা রান্না করেছে বছরের পর বছর।ধোঁয়া; কয়লার ধুলোয় ধুসরিত হয়ে যখন থালায় গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত আর খাসির মাংসের ঝোল এসে হাজির হত তখন মনটা কিশোরকুমার হয়ে যেত;
‘ মনে হয় স্বর্গে আছি……



খাসির মাংস পাতে আসার আগে একটা ট্রেলার থাকত; কষা হয়ে গেলেই চার ভাইবোনে বাটি হাতে ঘুরঘুর করতাম। এখানেও বড় হিসেবে অ্যাডভানটেজ। প্রথম টেস্টের অধিকার বড় হিসেবে আমার।দুপুরে খাবার সময় বাবা সবাইকে নিয়ে গোল হয়ে মাটিতে বসত। প্রথমে প্রিলিউডের মত একটা ডাল বা ভাজি থাকত। তারপর সেই অমোঘ আলু। শেষে সেই মহার্ঘ্য মাংস। আর এক পিস নাও… বলতে বলতে মা দিয়ে যেত…
সত্যি বলতে পরে লুকিয়ে দেখেছি; সবাইকে দিয়ে মায়ের ভাগ্যে হাড় চোষাই জুটত।আমার বাবা মৃত্যুর আগে মাকে আমিষ খাবার পারমিশন দিয়ে গেছিল।তবুও মা আর মাংস খেতে পারে না।বয়স বেড়ে গেছে।



এহেন বাবা মৃত্যুর আগে আমার কাছে ছেলে মানুষের মত বায়না করেছিল; খাসির মাংস খাবার। তখন আমরা বস্তিতে থাকি। নুন আনতা পান্তা ফোরায়। আমি দু একটা টিউশন করি।একটা কাজ ছিল; তাও চলে গেছে।সামনে আবার ইতিহাসের বি এ পরীক্ষা। অনেক হিসেব করে আড়াইশো মুরগীর মাংস এনে দিয়েছিলাম। পরের দিনই বাবা বিনা নোটিশে চলে গিয়েছিল।



আমার খাসির মাংস খাবার ঝোঁক কিন্তু রয়ে গেল। কাজে যোগ দেবার পর দিনেশেদা আর ফজলুলের সাথে অনেক ভোজ অ্যাটেন্ড করেছি।কবজি ডুবিয়ে খেয়েছি।সে স্বাদের ভাগ হবে না। দিনেশদা অবশ্য নিজে না খেয়ে খাওয়াতে ভালবাসত ঠেসেঠুসে। সে ইমোশনাল অত্যাচার চোখে জল এনে দিত। আনন্দের অশ্রু।
হঠাৎ আমার প্রেসার বাড়তে শুরু করল। বজ্জাত কোলেস্টেরল শরীরে বাসা বাঁধল। ডাক্তার দে আমায় খুব ভালবাসেন। কড়া ভাবে বললেন;খাসির মাংস কম খাবে কিন্তু।
এমনও হয়েছে; বিয়ে বাড়িতে নিজের মনকে চোখ ঠার দিয়ে পাতে মাংস আপন করে টানতে যাব। হঠাৎ ডাক্তার দে।
ভাতের মধ্যে কারসাজি করে মাংস চাপা দিচ্ছি বেড়ালের মত।ডাক্তারবাবু দেখে ফেললেন। তারপর গম্ভীর ভাবে মুচকি হেসে বললেন; ‘ দু পিস খেয়ে নাও।কিছু হবে না…

See also  আউসগ্রামের মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনায় বিহার থেকে গ্রেপ্তার ২



এখন মাংস পুরো নিষেধ। অ্যাকিউট অ্যানজানইনা আর অ্যাঞ্জিও হয়ে গেছে।মাংস শুধু শ্বশুরবাড়ি গেলে অথবা বাঙাল পাড়ায় তরকারি বিনিময়ে গিফট পেলে। তাও এক টুকরো।প্রসাদের মত।
সেদিন আমার শ্যালক বাবুরা এসেছিল।ও; উর্মি আর ওর দুরন্ত এক্সপ্রেস ছেলে ভোম্বল। বাজারে গিয়ে খাসির দোকানে মাংস আনা হল। গর্দান শেষ।রান থেকেই দিল। সেই দোকানদারের নামও বাবু।
যাই হোক; বউ তো জমিয়ে রাঁধল। কত বছর পর….



কিন্তু খেতে বসে হতাশ হলাম। সেই স্বাদ কোথায়। সবই আছে। নতুন আলু; মশলা সবই।কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে গেছে। অনেক জাঁক করে রিলিজ হওয়া ফিল্মের মত! বাকিরা সবাই বলল ; না ; মন্দ হয়নি। আমিই শুধু কাঁসার বাটিতে আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করে সেই স্বাদ খঁুজে গেলাম। বউ বলল; ‘ আর এক পিস নাও।মেটে আছে। কিছু হবে না…

আমি বললাম; ‘ না। থাক।মাংসের স্বাদ হারিয়ে গেছে…

সবই মনের ব্যাপার। কী বলেন আপনি?

krishna Saha

আমার নাম কৃষ্ণ কুমার সাহা, আমি ফুল টাইম সাংবাদিকতা করি।গত ৮ বছর ধরে এই পেশায় আছি