প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় বর্ধমান
তৃণমূলকে ফাঁসাতে গিয়ে শেষে চরম ফাঁসা ফেঁসে গেলেন সিপিএম প্রার্থী দম্পতি।বোমা আমদানি করে দলের এক পার্টি কর্মীকে দিয়ে নিজের বাড়িতে বোমা মারানো করিয়ে এখন পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর থানার পুলিশের জালে বন্দি সিপিএম প্রার্থী সুশান্ত মণ্ডল। গ্রেপ্তার হয়েছে তাঁরই দলের পার্টি কর্মী রাম সরকার।আর গ্রেপ্তার হতেই সিপিএম প্রার্থী দম্পতি সুশান্ত মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী দেবিকা দেবনাথের গোটা পরিকল্পনার কথা পুলিশের কাছেফাঁস করে দিয়েছে রাম। তা জানার পর থেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছে
সিপিএম প্রার্থী দেবিকা দেবনাথ।পুলিশ তারও
খোঁজ চালাচ্ছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে,এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে জামালপুর ১ পঞ্চায়েতের ১৪১ নম্বর বুথে সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন সুশান্ত মণ্ডল।
আর তাঁর স্ত্রী দেবিকা দেবনাথ একই পঞ্চায়েতের ১৩৯ নম্বর বুথে সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন।এই দম্পতির বাড়ি জামালপুরের উত্তর মোহনপুর গ্রামে
একই গ্রামে বসবাস করেন পেশায় ফুচকা বিক্রেতা রাম সরকার।সিপিএম প্রার্থী দম্পতির হয়ে ভোটের প্রচার দেওয়াল লিখন সহ নানা কাজে উত্তর মোহনপুর ও তার সংলগ্ন জামালপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বেশকিছু সিপিএম কর্মী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।তাঁদেরই মধ্যে রাম সরকার অন্যতম একজন।
তৃণমূল কংগ্রেস আশ্রিত দুস্কৃতিরা রাতের অন্ধকারে তাঁদের বাড়িতে বোমা মেরেছে, এমন অভিযোগ এনে গত ২৫ জুন সকাল থেকে তোলপাড় ফেলে দেন সিপিএম প্রার্থী দম্পতি। ওইদিনই পার্টির প্যাডে সিপিআইএম জামালপুর ১ এরিয়া কমিটির সম্পাদক সুকুমার মিত্র জামালপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। সেই অভিযোগে তিনি দাবি করেন,’রাতের অন্ধকারে তাঁদের দলের প্রার্থী দম্পতির বাড়িতে বোমা ছুঁড়ে মেরেছে তৃণমূল কংগ্রেস আস্রিত স্থানীয় দুস্কৃতিরা“ ।পুলিশকে সুকুমার মিত্র এও জানান,“তাঁদের প্রার্থী দম্পতি সুশান্ত মণ্ডল ও দেবিকা দেবনাথের বাড়িতে তিনটি বোমা ছোঁড়া হয়েছিল।তার মধ্যে দুটি বোম ফাটেনি,একটি ফেটেছে“।এই ঘটনায় সিপিএম নেতা সুকুমার মিত্র জামালপুর ১
পঞ্চায়েতের একটি বুথে প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল প্রার্থীর স্বামী এবং তার এই সহযোগীকে নিশানা করেন ।সিপিএম প্রার্থী দম্পতিও ওইদিন সংবাদ মাধ্যমের কাছে একই অভিযোগ করেন।
সিপিএম নেতার কাছ থেকে এমন অভিযোগ পেয়ে
নড়ে চড়ে বসে জামালপুর থানার পুলিশ। মামলা রুজু করে পুলিশ তদন্তে নামে। তদন্তে নেমে পুলিশ
বিভিন্ন ভাবে খোঁজ খবর চালিয়ে জানতে পারে, উত্তর মোহনপুর গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে রাম সরকার নামে ২৯ বছর বয়সী যুবক ২৪ জুন অনেক গভীর রাতে বাড়ি ফিরেছিল।এরপর পুলিশ
প্রযুক্তির ব্যবহার করে রাম সরকার ও সুশান্ত মণ্ডলের বিষয়ে বেশ কিছু ’ক্লু’ পায়।
প্রযুক্তির ব্যবহার করে পুলিশ নিশ্চিৎ হয়ে যায় ঘটনার দিন গভীর রাত পর্যন্ত শুধুমাত্র সুশান্ত মণ্ডল ও রাম সরকারের ফোন ’অ্যাকটিভ’ ছিল। পঞ্চায়েত ভোটের গণনা পর্ব মিটতেই ১৬ জুলাই রাতে পুলিশ রাম সরকারকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে গিয়ে জেরা শুরু করে।জেরার সন্মুখিন হয়েই সিপিএম কর্মী রাম সরকার তাঁর এবং সিপিএম প্রর্থী দম্পতির করা গোটা ’গেমপ্ল্যান’পুলিশকে জানিয়ে দেয়।
পুলিশ জনিয়েছে ,ধৃত রাম সরকার জেরায় কবুল করেছে ,পঞ্চায়েত ভোটের নমিনেশন জমা দেওয়া পর্ব শুরুর আগে এক রাতে সুশান্ত ও দেবিকার বাড়িতে ৪-৫ জন আসে। তারা কেউ জামালপুরের
বাসিন্দা নয়। অন্য জেলার লোক হবে। ওই ব্যক্তিরা ওইদিন সুশান্ত ও দেবিকাদের বাড়িতে রাত কাটায় ।ওইসব ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়েই তৃণমূলকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা চুড়ান্ত করে ফেলে দেবিকা ও সুশান্ত। সেই পরিকল্পনা সফল করতে রাম সরকারকে বেছে নেয় দেবিকা ও তাঁর স্বামী সুশান্ত
।
পরিকল্পনা মাফিক ২৪ জুলাই রাতে জামালপুরের সিপিএম পার্টি অফিসের অদূরে দোলরডাঙ্গা এলাকায় মাংস ভাতের ফিস্টের আয়োজন করে সিপিএম প্রার্থী দম্পতি। তার কাছে পিঠে চলছিল রাত্রিকালীন ক্রিকেট প্রতিযোগীতা । সেইখানে রাতে ফুচকা বিক্রি স্টল বসিয়েছিল রাম।রাত সাড়ে ১০ টা নাগাদ সুশান্ত মণ্ডল প্ল্যাসটিক প্যাকেটে মুড়ে তিনটি বোম রাম সরকার কে গিয়ে দেয় এবং সেগুলি কি করতে হবে সেটা আরো একবার মনে করিয়ে দেয়।রাম সরকার বোমগুলি ফুচকার ট্রলি গাড়ির গোপন জায়গায় রেখে দেয় । রাত পৌনে ২ টো নাগাদ বোম সহ ফুচকার গাড়ি নিয়ে রাম উত্তর মোহনপুরে তাঁর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
দেবিকাদের বাড়ির কাছেই বাড়ি রাম সরকারের। ফুচকার গাড়িটি নিজের বাড়ির দরজার কাছে দাঁড় করিয়ে রেখে রাম সরকার পরিকল্পনা মত ওই রাতেই সিপিএম প্রার্থী দম্পতির বাড়িতে যায় ।তাদের বাড়ির উঠানের দু’জায়গায় দুটি বোম ফেলে রাখে।এর পর সে সিপিএম প্রার্থী দম্পতির বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গিয়ে একটি বোম তাদের বাড়িতে ছুঁড়ে মারে। বিকট শব্দে বোমটি ফাটার সাথে সাথে রাম সরকার ছুটে নিজের বাড়িতে গিয়ে ঢুকে পড়ে।আর পরিকল্পনা মাফিক বোম ফাটার পরেই সিপিএম প্রাথী দম্পতি চিৎকার চেঁচামেচি করে পাড়া মাতিয়ে তোলে ।
জেরায় রাম সরকার এমনটা কবুল করার পরেই পুলিশ ’এক্সপ্লোসিভ এ্যাক্টে’ মামলা রুজু করে তাকে গ্রেপ্তার করে।সোমবার ধৃতকে পেশ করা হয় বর্ধমান আদালতে।ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী
ও বোমা সরবরাহকারীদের নাগাল পেতে তদন্তকারী অফিসার ধৃতকে ১০ দিন নিজেদের হেপাজতে নিতে চেয়ে আদালতে আবেদন জানায়। ।বিচারক ৫ দিনের পুলিশ হেপাজত মঞ্জুর করেন। রাম সরকারকে হেপাজতে নিয়েই পুলিশ সিপিএম
প্রার্থী দম্পতির খোঁজে নেমে পড়ে। সোমবার গভীর রাতে পুলিশ উত্তর ২৪ পরগনার ঘোলা থানা এলাকার একটি ডেরা থেকে সিপিএম প্রার্থী সুশান্ত মণ্ডল কে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশের দাবি ,নিজেদের চারচাকা গাড়িতে করেই নদীয়া ও উত্তর ২৪ থেকে
বেশ কিছু বোম জামালপুরের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল সিপিএম প্রার্থী দম্পতি।এই কাজে সুশান্তর ভাই প্রশান্ত অন্যতম সহযোগী ছিল বলে পুলিশ জেনেছে।সুশান্তদের চারচাকা গাড়িটি পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে।বাকি বোম উদ্ধার এবং প্রশান্ত ও দেবিকা সহ গোটা ঘটনায় জড়িত অন্যদের খোঁজ পেতে পুলিশ এখন মরিয়া। সুশান্ত মণ্ডলকে মঙ্গলবার বর্ধমান আদালতে পেশ করে তদন্তকারী অফিসার ১০ দিনের পুলিশি হেপাজতে নিতে চেয়ে আবেদন জানায়।বিচরক ধৃতের ৭ দিনের পুলিশ হেপাজত মঞ্জুর করেছেন।
এবিষয়ে জামালপুর ব্লক তৃণমূলের সভাপতি মেহেমুদ খাঁন এই প্রসঙ্গে এদিন বলেন,’সিপিএমের মখোশ সিপিএমের কর্মীই খুলে দিয়েছে।এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করছি তৃণমূল কে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে সপিএম ও বিজেপি যৌথ ভাবে এই পরিকল্পনা করেছিল। পুলিশ তদন্তকরে যথাযথই ব্যবস্থা নিয়েছে। সিপিএমের এই অপকর্মের জবাব জামালপুরের মানুষ পঞ্চায়েত ভোটে দিয়েছে।লোকসভা ভোটেও
জামালপুরের মানুষ সিপিএম কে প্রত্যাখ্যান করেবে“।
আর সিপিএম নেতা সুকুমার মিত্রর বলেন,
,“আদালতের বিচারাধীন বিষয় নিয়ে এখনই কোন মন্তব্য করবো না। তবে যা শুনছি ,ঘটনা যদি তাই হয় তবে আমরা আমাদের পার্টির পক্ষথেকে এবিষয়ে যথা যথ ব্যবস্থা নেব। সিপিএম পার্টিতে অপকর্মের কোন জায়গা নেই“। যদিও ধৃত সিপিএম কর্মীর মা পুষ্পদেবী এদিন বলেন,
“সিপিএম প্রার্থী দম্পতি সুশান্ত মন্ডল ও দেবিকা দেবনাথ তাঁদের পরিকল্পনা সার্থক করতে আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে“।