রথীন রায় :- বাংলা-বিহার-ওড়িশার রাজধানী মুর্শিদাবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগেই বাংলার বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র কাশিমবাজারের আবির্ভাব হয়েছিল ! এই কেন্দ্রকে ঘিরে সেখানে দেশি ও বিদেশি বণিকরা ভিড় জমিয়েছিলেন ! আনুমানিক ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিবেণীর কাছে ভাগীরথীর গতিপথের পরিবর্তন হওয়ার জন্য সরস্বতী নদীতীরের বন্দর সপ্তগ্রামের বাণিজ্য হ্রাস পেতে থাকে ! বাংলার উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যবর্তী স্থানে আনুমানিক ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে কাশিমবাজার বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করতে শুরু করে ! অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে এলে কাশিমবাজারের ব্যবসা-বাণিজ্য বহুগুণ বেড়ে যায় !
সপ্তগ্রাম বন্দরের পরে আর কলকাতা বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠার মাঝে কাশিমবাজার ছিল বাংলার শ্রেষ্ঠ বাণিজ্যকেন্দ্র ! বহরমপুর থেকে কাশিমবাজার সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ! সে সময় পদ্মা ভাগীরথী ও জলঙ্গী নদীবেষ্টিত ত্রিকোণ ভূমিখণ্ড ছিল কাশিমবাজার ! তিন দিকে নদী থাকার কারণে জলপথ ও স্থলপথ উভয় দিকেই সুবিধা ছিল ! তখন বহরমপুর থেকে মুর্শিদাবাদ যেতে নৌকায় একদিন লেগে যেত কারণ এই দুই স্থানের মধ্যে একটা বড় বাঁক ছিল ! দুই বাঁকের মধ্যে একটি খাল কেটে ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে পথের সময় কমানোর চেষ্টা করা হয়, কিন্তু ভাগীরথীর প্রবাহ এই পথ দিয়ে চলতে শুরু করে ! যে নদীর বাঁকে কাশিমবাজার বাণিজ্যকেন্দ্রটি ছিল তা একটি বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়, পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে !

যে অঞ্চল একসময় পৃথিবীর বিভিন্ন বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ, লোকলস্করে ভর্তি থাকত তা আস্তে আস্তে জনশূন্য হতে থাকে ! কলকাতা বাণিজ্যকেন্দ্রের অগ্রগতির সঙ্গে লড়াই করে ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালিকাপুর, শ্রীপুর, ভাটপাড়া, ফরাসডাঙ্গা, কুঞ্জঘাটা, বিষ্ণুপুর, দায়নগর, চুনাখালি প্রভৃতি জনপদ নিয়ে বৃহত্তর কাশিমবাজার ছিল ! কাশিমবাজার থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে, পূর্ব এশিয়ার এবং ইউরোপের নানা দেশে পণ্যদ্রব্য রপ্তানি হত ! রেশম ছিল প্রধান পণ্য, নানা রকমের রেশমি কাপড় এখানে তৈরি হত ! তাছাড়া সুতির কাপড়, ঘি, লঙ্কা, নীল, মোম, কর্পূর, ফিটকিরি, পারদ, চিনামাটির বাসন, দস্তার সামগ্রী, হাতির দাঁতের জিনিসপত্র-সহ নানা জিনিসের ব্যবসা চলত ! কাশিমবাজারে ইংরেজদের কুঠি ছিল !
১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জব চার্নক এখানে মাসিক ২৫ টাকা বেতনের ইংরেজ কুঠির সহকারী অধ্যক্ষ ছিলেন ! ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস একজন সাধারণ কর্মচারী ছিলেন ! ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার বিবাদ বাধলে নবাব কুঠি আক্রমণ করে ওয়ারেন হেস্টিংসকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ! কাশিমবাজারের কাছে কালিকাপুরে ওলন্দাজদের কুঠি, সৈদাবাদের ফরাসডাঙ্গায় ফরাসিদের কুঠি ও সৈদাবাদের শ্বেতা খাঁর বাজারে আর্মেনীয়দের বাণিজ্য কুঠি ছিল ! এছাড়া বাঙালি ব্যবসায়ী, গুজরাতি ও মাড়োয়ারি বণিকরাও এসেছিলেন ! কাশিমবাজারের আগে নাম ছিল মাসুমাবাজার ! রণনিপুণ যোদ্ধা কাশিম খান হুগলি দুর্গ থেকে কয়েকজন সুন্দরী স্ত্রীলোক নিয়ে এসে এখানে রাখেন !
তারপর এর নাম হয় কাশিমবাজার ! অনেকে মনে করেন কাশিম খানের অকালমৃত্যুতে তাঁর স্মরণে এই স্থানের নাম রাখা হয় কাশিমবাজার ! ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ থেকে জানা যায় কাশিমবাজারের সমৃদ্ধির সময় পরপর গগনস্পর্শী অট্টালিকা এমন ঘন সন্নিবিষ্টভাবে ছিল যে লোকে ছাদের ওপর দিয়ে দুই-তিন ক্রোশ যাতায়াত করতে পারত ! কাশিমবাজার বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল সতেরো, আঠেরো ও উনিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত ! যখন উন্নতির শিখরে ছিল তখন তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা বহু কিছুই আজ আর নেই ! সেগুলি হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট হয়েছে কাশিমবাজার তথা বাংলার অনেক ঐতিহ্য ! এখানে বড় বড় জাহাজ ভেড়ানোর জন্য কাটিগঙ্গার তীরে বড় জাহাজঘাটা ছিল !
ভগ্ন অবস্থার সেই জাহাজঘাটার জেটি ও ঘাটের সব ইট ১৯৭৬ সালে তুলে নেওয়ায় পুরনো ঐতিহ্য নষ্ট হয়েছে ! কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি, কালিকাপুরের ওলন্দাজ দুর্গ, কুঠি ও গির্জা, শ্বেতা খাঁর বাজারে আর্মেনীয় কুঠি, সৈদাবাদের ফরাসডাঙ্গায় ফরাসি কুঠি, বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে থাকা কুঠি, বড় বড় অট্টালিকা কোনও কিছুর অবশিষ্টাংশ পর্যন্ত নেই ! মহাজনটুলিতে বিখ্যাত প্রাচীন নেমিনাথের মন্দির জৈন বণিকরা তৈরি করেছিলেন ! প্রস্তরনির্মিত নেমিনাথের মূর্তি উচ্চ আসনে ছিল, তার সঙ্গে মন্দিরের মধ্যে পার্শ্বনাথ-সহ ২৪ জন তীর্থঙ্করের মূর্তি ছিল ! মন্দিরের পূর্ব দিকে এক বিশাল উদ্যান ও বড় জলাশয় ছিল যার নাম ছিল মধুগড় ! শোনা যায়, বর্গী আক্রমণের সময় জৈন বণিকরা তাঁদের ধনরত্ন এখানে লুকিয়ে রেখেছিলেন !
তার কোনও চিহ্নই আর বর্তমানে নেই, স্থানীয় মানুষরা বলতেও পারেন না মন্দিরের সঠিক অবস্থানের জায়গা ! মধুগড় এখন একটি মজা পুকুরে পরিণত হয়েছে ! মন্দিরের ২৪ জন তীর্থঙ্করের মূর্তি আজিমগঞ্জের মন্দিরে রক্ষিত আছে ! এভাবে বহু মন্দির-দেবালয় আজ ধ্বংসস্তূপ বা মাটিতে মিশে গেছে ! এখনও কাশিমবাজারে গিয়ে দাঁড়ালে অতীত বাংলা ও বাঙালির গৌরবের জন্য গর্ববোধ হয় ! ইতিহাসের মণিমুক্তো ছড়িয়ে আছে কাশিমবাজারে ! মন্দির, মসজিদ আর গির্জার সমাহার এমনভাবে ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে রয়েছে খুব কম জায়গায় ! এরকম অসাধারণ ঐতিহ্য অবহেলায় নষ্ট হতে দেখে কষ্ট হয় ! অনুশোচনা হয় এই ভেবে যে এই বিপুল ঐশ্বর্য পর্যটনের এক বিরাট অংশ হতে পারত !
প্রত্যেক বাঙালির উচিত বাঙালি শিক্ষা-সংস্কৃতির উৎসাহদাতা নন্দী পরিবারের রাজবাড়িটি ঘুরে দেখা ! কাশিমবাজারের শ্রীপুরে বাংলার অন্যতম রাজবাড়ি হতশ্রী অবস্থায় এখনও দাঁড়িয়ে আছে ! সামনের জমি বিক্রি হয়ে বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে ! রাজবাড়ির ভেতরে যাওয়া বন্ধ ! বহু ভবনের ছাদ ভেঙে পড়ছে ! অথচ বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকেও এখানে দুর্গাপূজা হত ! উত্তরাধিকারীরা বাস করতেন ! বাংলার অন্যতম রাজবংশ হিসেবে পরিচিত ছিল এই কাশিমবাজার রাজবংশ ! কাশিমবাজার সমৃদ্ধ বন্দর থাকাকালীন নানা দেশের বণিকরা এখানে কুঠি স্থাপন করে বাণিজ্য করতেন ! কাশিমবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণকান্ত নন্দীর পূর্বপুরুষদের এখানে রেশম ও সুপারির ব্যবসা ছিল !
কান্তবাবুর একটি মুদির দোকান ছিল বলে তিনি ‘কান্ত মুদি’ নামে পরিচিত ছিলেন ! তিনি বাংলা, ফারসি ও সামান্য ইংরাজি জানতেন ! ইংরেজদের কুঠির সামনে তাঁর দোকান থাকায় তাঁর সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক ভাল ছিল ! ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে সিরাজউদ্দৌলা কাশিমবাজারে ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করলে পলাতক ওয়ারেন হেস্টিংসকে কেউ আশ্রয় দিতে রাজি হননি ! কান্তবাবু নবাব সৈন্যের ভয় উপেক্ষা করে হেস্টিংসকে আশ্রয় দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিলেন ! পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস যখন গভর্নর হন তখন কান্তবাবু বন্ধু গঙ্গাগোবিন্দকে সঙ্গে নিয়ে হেস্টিংসের দরবারে হাজির হলেন ! হেস্টিংস পূর্ব উপকারের স্বীকৃতিস্বরূপ কান্তবাবুকে উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত করেন ও বহু ভূসম্পত্তি প্রদান করেন ! পলাতক ওয়ারেন হেস্টিংসকে দুঃসময়ে রক্ষা করার জন্য কাশিমবাজার রাজপরিবারের এই বিশাল সম্পত্তি ও বৈভব ! সেই আমলে কান্তবাবু বিশাল জমিদারি অর্জন করেছিলেন আইনি-বেআইনি নানা পথে !
তিনি কাশিমবাজারের এই শ্রীপুর রাজপ্রাসাদ ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ! কৃষ্ণকান্ত নন্দীর মৃত্যুর পর জমিদার হন তাঁর পুত্র লোকনাথ ! তারপর তাঁর পুত্র হরিনাথ ও তারপর তাঁর পুত্র কৃষ্ণনাথ নন্দী জমিদার হয়েছিলেন ! কৃষ্ণনাথের জন্ম ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে, তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন ! শিক্ষাবিস্তারের জন্য বহু টাকা দানও করেছেন ! তিনি স্বপ্ন দেখতেন বহরমপুরে এমন কলেজ হবে যেখানে ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, আইন ও চিকিৎসাবিদ্যা পড়ানো হবে ! ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অকালপ্রয়াণের সময় জানা যায় তিনি একটি উইলে বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল তৈরির কথা লিখে রেখে গেছেন ! রাজা কৃষ্ণকান্ত নন্দীর স্ত্রী মহারানি স্বর্ণময়ীদেবী রাজসম্পত্তির দায়িত্ব গ্রহণ করেন ! ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে বহরমপুর কলেজ রানি স্বর্ণময়ী ও অন্য বহুজনের দানে প্রতিষ্ঠা হয় !
দানশীলা স্বর্ণময়ীদেবী দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য দান করেছেন, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী হস্টেল তৈরিতেও অনেক দান করেছেন ! এরপর উত্তরাধিকারী হন কৃষ্ণনাথের বোনের ছেলে মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ! তিনিও আগের ধারা অক্ষুণ্ণ রেখে বহু জনদরদী কাজ করেছেন ! চিকিৎসাক্ষেত্রে, বিপ্লবীদের সহায়তায়, ভবানীচন্দ্র বোস বিজ্ঞান কলেজে, লুপ্তশিল্প উদ্ধারে, পত্রিকা প্রকাশে, মিউজিক স্কুল ও নাটক স্কুল স্থাপন-সহ বহু কাজে অর্থসাহায্য ও উৎসাহ দিয়েছেন ! তাঁর উদ্যোগে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন বাংলা ১৩১৪ সনের ১৭ ও ১৮ কার্তিক কাশিমবাজার রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ! সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ! মণীন্দ্রচন্দ্রর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী হন শ্রীশচন্দ্র নন্দী ও তারপরে উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন শ্রীশচন্দ্রের পুত্র সোমেন্দ্রচন্দ্র নন্দী ! এখনও এই রাজপ্রাসাদে গেলে বাইরে থেকে দেখে সম্ভ্রম জাগে ! বড় বড় থামের রাজপ্রাসাদের গাম্ভীর্য এখনও জানান দেয় !
ওয়ারেন হেস্টিংস যখন কাশীর রাজা চৈতসিংহকে আক্রমণ করেন তখন কান্তবাবু তাঁর সঙ্গে ছিলেন ! পরাজিত চৈতসিংহের প্রাসাদ থেকে কান্তবাবু একটি পাথরের দালান তুলে নিয়ে আসেন ! কাশিমবাজার রাজবাড়ির বৃহৎ ঠাকুর দালান ও বারান্দা কারুকার্যখচিত রক্তাভ গোলাপি পাথরের প্রায় একশোটি থাম ও পঞ্চাশটি পত্রাকৃতি খিলান দিয়ে সজ্জিত ! এগুলি কাশী থেকে আনা ! এছাড়া চৈতসিংহের প্রাসাদে মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য কাশী রাজমাতার কাছ থেকে কৃষ্ণকান্ত নন্দী বহুমূল্য অলংকার, লক্ষ্মীনারায়ণ শিলা, রামচন্দ্রী মোহর, দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ ও একমুখী রুদ্রাক্ষ পেয়েছিলেন !
এগুলি সবই রাজবাড়িতে পূজিত হত, বর্তমানে স্থানান্তরিত হয়েছে ! দোতলায় লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের চারপাশে পদ্মের অতি সুন্দর ফুলকারি কাজ ছিল ! বিশাল প্রবেশদ্বারে কাঠ খোদাইয়ের কাজ দেখা যায় ! আজ মূল দরজার ওপরে নোটিশ দেওয়া আছে, ‘রাজপ্রাসাদ দর্শন বন্ধ’ ! অনুমতিসাপেক্ষে প্রবেশ করলে ঐশ্বর্য ও বৈভবের খানিকটা আঁচ পাওয়া যায় ! নীচে ঝোপজঙ্গলে সাপের আস্তানা, দোতলায় প্রবেশপথ বন্ধ, বিভিন্ন জায়গায় ছাদ খসে পড়েছে ! এখনও হয়তো চেষ্টা করলে রাজপ্রাসাদ বাঁচানো যেতে পারে, না হলে খুব শীঘ্রই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে বাংলার ঐতিহ্য ও গর্বের কাশিমবাজার রাজবাড়ি !!