রথীন রায় : – সেই রবিঠাকুরের স্বপ্নের বোলপুর শান্তিনিকেতন এলাকায় বসেই অনুব্রতর মুখে শোনা যায় বারবার গুড় বাতাসার দাওয়াই ! বসন্তের ঝরা পাতার দিনগুলিতে তীক্ষ্ণ তাপের দাবদাহ থেকে রক্ষা পেতে একটু বাতাসা জল ! চ্যাপ্টা আকারের ২-৪ সেন্টিমিটার ব্যাস এর এই মিষ্টি খাবার টি চিনি অথবা গুড় থেকে তৈরি হয় ! ছোট বাচ্চাদের নিকট বেশ জনপ্রিয় ! প্রাচীন কাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দুরা বাতাসা প্রসাদ হিসাবে ব্যবহার করেন ! অনেক মন্দিরে “হরির লুট” নামে বাতাসা প্রসাদ হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়ার রীতি আছে ! কড়াইতে চিনি অথবা গুড়, জল একসঙ্গে ফোটাতে হবে !
ফুটে উঠলে দুধ দিয়ে ফেনার মতো ময়লা পরিষ্কার করে খাবার সোডা দেওয়া হয় ! ঘন ঘন হলে গোল চামচের এক চামচ করে বাঁশের ডালায় ফেলে ঠান্ডা করে জমিয়ে নিয়ে বাতাসা তৈরী করা হয় ! সাধারণত পৌষ সংক্রান্তিতে কদমা, বাতাসা, তিলের খাজা বেশি খাওয়া হয় ! মেলা, রথ প্রভৃতিতে বাতাসা অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ ! লক্ষ্মীপুজাতেও এর ব্যবহার আছে ! বাঙালির অতিথি আপ্যায়নে বাতাসার ব্যবহারের রীতি বেশ পুরনো ! বিভিন্ন লেখকের গল্পে লেখায় এর পরিচয় পাওয়া যায় ! পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২৫০০ কদমা বাতাসা ও নকুলদানা তৈরির ছোট ‘কারখানা’ রয়েছে ! বর্ধমানের নীলপুর, মালদার হরিশ্চন্দ্রপুর, গড়িয়া-বেলেঘাটা, উত্তরবঙ্গের বালুরঘাটে প্রচুর কারিগর বাতাসা-নকুলদানা তৈরির সঙ্গে যুক্ত !

ভাল চাহিদা থাকা সত্বেও বাতাসা-নকুলদানা-কদমাকে তেমন ভাবে বাজারজাত করায় সমস্যা আছে ! তবে এই প্রাচীন কুটির শিল্পের হাল ফেরাতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার আসরে নেমেছে ! পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ক্লাস্টার তৈরি-করে রপ্তানি করার বিভিন্ন পদক্ষেপ করার পরিকল্পনা নিয়েছে ! পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসরকারের খাদি গ্রামদ্যোগের উদ্যোগে ক্লাস্টার তৈরি করে কারিগরদের এক ছাদের তলায় এনে প্রথমে ছোটছোট ‘হাব’ তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ! সেখানেই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে কারিগরদের ! উদ্যগতাদের অভিমত, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশে বাতাসা্ কদমা এবং দেশের দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে নকুলদানার চাহিদা রয়েছে ! হাবে তৈরি হওয়া কদমা নকুললদানা বাতাসা আধুনিক প্রযুক্তিতে প্যাকেটজাত করে রপ্তানি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে !
ফলত কারিগর ও ব্যবসায়ী, উভয় পক্ষই লাভবান হবেন বলে মনে করছেন খাদি গ্রামোদ্যোগের কর্তারা ! বাতাসা চিনি বা গুড় দিয়ে তৈরি এক ধরনের মিষ্টিজাতীয় খাবার ! বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে এর প্রচলন বেশি ! একসময় মুড়ি ও বাতাসা দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হতো ! গ্রামাঞ্চলে এখনো এই রীতি কদাচিৎ চোখে পড়লেও শহরাঞ্চলে খুব একটা দেখা যায় না ! তবে প্রাচীনকাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দুরা বাতাসাকে প্রসাদ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে ! সুস্বাদু এই বাতাসা তৈরিতে চিনি বা গুড়ের পাশাপাশি দুধ, খাবার সোডা ও পানির প্রয়োজন হয় ! সাধারণত পৌষসংক্রান্তিতে মুড়ি, খই, কদমা, তিলের খাজার পাশাপাশি বাতাসাও খাওয়া হয় ! মেলা, রথ প্রভৃতিতে বাতাসা অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ ! দেশীয় ঐতিহ্যবাহী এসব খাবার মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া, ঢাকার ধামরাই, সাভার এবং বগুড়ার সদর উপজেলার হরিপুর গ্রামে সবচেয়ে বেশি তৈরি হয় !
এ ছাড়া দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আরো ছোটখাটো কারখানায় বাতাসা তৈরি হচ্ছে ! এসব খাবার আশপাশের এলাকার পাইকারদের মাধ্যমে সারা দেশে বিক্রি হয় ! এসব খাবার কবে থেকে, কিভাবে বাংলা অঞ্চলে চালু হলো তার ইতিহাস খুব একটা জানা যায় না ! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শুভদৃষ্টি’ গল্পে পিতলের রেকাবিতে করে বাতাসা নিয়ে বিয়ের সম্বন্ধ আনার বিষয়টি উল্লেখ আছে ! বাতাসায় চিনি বা গুড়ের পরিমাণ বেশি থাকায় এটি খেলে তাত্ক্ষণিক শক্তি পাওয়া যায় ! আমাদের হজমশক্তি বৃদ্ধি ও বিষণ্নতা দূর করতে সাহায্য করে এটি ! এটি মিষ্টিজাতীয় খাবার বলে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ক্ষতিকর ! চাঁদিফাটা গরমে এক টুকরো বাতাসা, সঙ্গে এক গ্লাস ঠান্ডা জল পেলে সব ক্লান্তি, অবসাদ দূর !
তাই বাতাসার কদর নেহাত কম নয় ! যে কোনও শুভ কাজে, মন্দিরে-মসজিদ-গুরুদ্বারে বাতাসা লাগেই ! ইদানীং রাজনৈতিক তরজাতেও বাতাসার নাম বার বার উঠে আসছে ! বারাসতের কাছে মধ্যমগ্রামে বাতাসার আধুনিক কারখানা থাকলেও ভাঙড়ের কাশীপুর, মিনাখার মালঞ্চ, জীবনতলা, বারুইপুরেও ঘরে ঘরে বাতাসা তৈরি হয় ! ছোট ছোট হাঁড়ি, শীতল পাটির চাটাই আর কাঠ কয়লার উনুনে আজও গ্রামীণ বাতাসাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন প্রান্তিক বাতাসা শিল্পীরা ! এক কেজি বাতাসা ৫২ টাকা দরে পাইকারি বাজার বিক্রি করেন ! মুদির দোকানে তা খুচরো বিক্রি হয় ৬০ টাকা কেজিতে !
প্রতিদিন সাত আট ঘণ্টা কাজ করলে একজন কর্মচারী কমবেশি ১০০ থেকে ১২০ কেজি বাতাসা তৈরি করতে পারেন ! যা করতে খরচ পাঁচ হাজার টাকা ! আর বিক্রি, ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা ! প্রসঙ্গত আগামী আসানসোল লোকসভা উপ-নির্বাচনে কখন আবার বলতে শোনা যাবে “গুড় বাতাসার ব্যবস্থা আছে” !!