আমি সেই সীমন্তিনী যে গত কোনো শতাব্দীতে নাকের নোলকে গঙ্গাপথ যাত্রী স্বামীর প্রাণ ভ্রমরা বেঁধে সিঁদুরে হয়েছি রাঙা ।অবশেষে যখন স্বামীর পরিপক্ক প্রাণ ভ্রমরা ধরে ব্যার্থ হয়েছি তখন জ্বলে পুড়ে মরেছি ব্রাহ্মণ্যবাদের ভ্রান্ত প্রথার সহমরণ চিতায় ।কখনও আবার সাদা থানের সাজে মুখ লুকিয়ে রেখেছি বন্ধ ঘরের এক কোণে ।যেখানে রোদ্দুর ঢেউ খেলেনা ঘোমটা ওড়ানো চুলে।ছটফটিয়ে মরেছি নির্জলা একাদশীর কঠিন ব্রতাচারে । নিয়ম পালনে ব্যার্থ হলে জুটেছে ঝাঁটা লাথি । অবঞ্জার আমন্ত্রণে একাকার হয়ে গেছে কুমারীত্ব ,সতীত্ব,
বৈধব্যের যন্ত্রণা ।
আমি সেই অন্তঃপুর বাসিনী, যাকে রজস্বলার দোহাই দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে গুমট বন্ধ দৈর্ঘ্য প্রস্থের আড়ালে, যেখান থেকে অস্পৃশ্যতা অশুচিতা দরজা ভেদ করে বেরোতে পারেনা অন্দরমহলে,কপাটের ওপারে পৌঁছাতে পারেনা অসহ্য যন্ত্রণা আর কাতর ডাকের শব্দ ।
আমি সেই যোষিতা যে জন্মের পর থেকেই দিন গোনা শুরু করেছি বিবাহের যজ্ঞে হাড়িকাঠে বলী হবার জন্য । সংসারের দায় ভার মাথায় তুলে নিয়েছি একাধিক সতীনের সাথে ভাগ করে ।সন্তান জন্ম দিতে দিতে স্যাঁতস্যাঁতে আঁতুড় ঘরে খড়ের বিছানায় ওলট পালট করেছি সূতিকার যন্ত্রণায়।অনাহারে অনাদরে প্রসব করেছি মৃত সন্তান,কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে পেয়েছি অলক্ষ্মী অপয়ার তকমা ,হয়েছি সবার চোখের বালি ।
আমি সেই ভামিনী যে শুধু স্বামীর গরবে গরবিনী হয়ে হয়েছি স্বামির অতৃপ্ত ক্ষুধার শিকার ।মনের খিড়কি তে বার বার টোকা দিয়েও পাইনি প্রেম পাইনি ভালোবাসা । পেয়েছি শুধু অত্যাচার অবহেলা লাঞ্ছনা ।
আমি সেই আওরাত যাকে পিতৃ তান্ত্রিক সমাজ ভোগ্যবস্তু মনে করে অসম্মানের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে লুটেছে ইজ্জত ,ছিঁড়েছে অলঙ্কার ,কেড়েছে অহংকার । যৌন পিপাসার তাগিদে মুখে রঙ মাখিয়ে হাঁটু মুড়ে বসিয়ে দিয়েছে অন্ধ গলির মোড়ে ।
আবার কখোনো বা আমায় প্রমদা ,বনিতা,বামা, বলে আদিখ্যেতা করেছে কাব্যে প্রেমে । কখোনো আবার প্রকৃতি বলে দেবী বলে করেছে শ্রদ্ধা ভক্তি । সত্যিই অজানা এই পুরুষ তান্ত্রিক সমাজের আসল উদ্দেশ্য কি আমায় নিয়ে? স্বর্গবাসে ভক্তি আর মর্ত্য বাসে অবহেলার মাঝে নিজের জীবনের হিসাব মেলাতে গিয়ে বুঝেছিলাম এই জগত সংসারে আমার ভূমিকা খুব ব্যায় বহুল । আমার নিজের বৈশিষ্ট্য আমি নিজেই ধারন করি । আমিই সৃষ্টি আমিই শান্তি আমিই ধ্বংস ।আমার ভূমিকা ছাড়া তাদের অত্যাচারের, শ্রদ্ধার অস্তিত্ব বজায় রাখা অসম্ভব । শতাব্দীর পর শতাব্দী আমি সেই ভূমিকা পালন করে চলেছি ।
পার্থক্যের খাতিরে কখনো হয়েছি বলী কখনো দিয়েছি শাস্তি । আমি সেই আদ্যাশক্তি মহামায়ার অঙ্গ বিচ্যুত রূপ যার মধ্যে রয়েছে শুধু সহ্য ধৈর্য জোরআমি সেই সতির একান্ন অস্থির ছিটকে যাওয়া কনাযাতে আছে ক্রোধ রোধ আগুনআমি যামিনী আমি কামিনী আমি শর্বরী আমি ,প্রতি পদর্শিনী আমিই সেই ভূমিকাবহুল অনন্যা, সনাতনী ,কৌশিকী ।
হ্যাঁ আমিই সেই ষোল কলায় পরিপূর্ণ দু অক্ষরের লিঙ্গ ভিত্তিক একটি শব্দ নারী । যার ভূমিকার বিস্তার অনেক দূর ।
আমিই সেই নব আলোকে নব সৃষ্টির সুর ।