পারলৌকিক ভোজে ইতি টেনে সমাজকল্যাণের পথে গাছমাস্টারের পরিবার
মা–বাবার স্মরণে লোক খাওয়ানো নয়, বৃক্ষরোপণ ও সেবামূলক কর্মসূচিতে গাছ গ্রুপের অঙ্গীকার
গত ১৪ জুলাই ভোররাতে বর্ধমানের নিজগৃহে পরলোকগমন করেন গাছ গ্রুপের অরূপ চৌধুরীর মা মাধবী চৌধুরী। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকায় মৃত্যুর বেশকিছু দিন আগে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল নার্সিংহোমে, যেখানে চিকিৎসকেরাও তাঁকে “গাছ গ্রুপের মা” বলেই ডাকতেন। তাঁর প্রয়াণে যথাযথ পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন করলেও, চৌধুরী পরিবার এক বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে—তাঁরা আর আত্মীয়-পরিজনদের খাওয়ানোর প্রচলিত পারলৌকিক রীতি অনুসরণ করবেন না।

এই সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নেওয়া হয়নি। এর পেছনে রয়েছে এক গভীর উপলব্ধি ও সামাজিক দায়বদ্ধতা। ২০১৯ সালে জনরঞ্জন চৌধুরী, অরূপবাবুর পিতা প্রয়াত হন। সেই সময়ে তাঁর শ্রাদ্ধে প্রচলিত নিয়মে অনুষ্ঠানবাড়ি ভাড়া করে, অতিথি-আপ্যায়ন করে যথেষ্ট খরচ হয়েছিল। তখনই অরূপ ও অনুপ দুই ভাই অনুভব করেন, এর বদলে যদি সেই অর্থ সমাজকল্যাণে ব্যয় করা যেত, তবে সেটাই পিতার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধাঞ্জলি হতো। তখনই মায়ের অনুমতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, ভবিষ্যতে এধরনের ভোজ আয়োজন আর করবেন না।
এই প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়ন ঘটেছে মায়ের মৃত্যুর পর। ২৬ জুলাই ছিল লোক খাওয়ানোর নির্ধারিত দিন, কিন্তু তা বাতিল করে চৌধুরী পরিবার মা-বাবার স্মরণে এক বছরের জন্য শুরু করেছে একাধিক সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি।
ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে কর্মসূচির বাস্তবায়ন:
১. ২৭ জুলাই: অরূপ চৌধুরী, অনুপ চৌধুরী ও তাঁদের পরিবার “গাছ গ্রুপ” এবং “রায়ান মিলন সংঘ”-এর সহযোগিতায় রায়ানের মা খণ্ডবনে ১০০টি নিম গাছের চারা রোপণ করেন।
২. আগামী এক বছর: বর্ধমান রামকৃষ্ণ মিশনে নবদীক্ষিতদের দেওয়া ‘জবা শিশু’ গাছ বিতরণের ব্যয়ভার বহন করবেন চৌধুরী পরিবার।
৩. জন্মভূমি বামুনিয়া গ্রামে: স্থানীয় বাস্তুদেবতা ধর্মরাজের মন্দির তহবিলে আর্থিক অনুদান ও গরীব বিধবাদের জন্য কম্বল বিতরণের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।
অরূপবাবু স্পষ্ট করে বলেন,
“বাবা-মায়ের জীবদ্দশায় তাঁদের সেবা করাই সন্তানের আসল কর্তব্য। মৃত্যুর পর লোক খাওয়ানো কোনও মানবিক সংস্কার নয়—এটা বন্ধ হওয়া দরকার। অনেকেই এই কারণে আর্থিক সংকটে পড়েন, ঋণগ্রস্ত হন।”
তিনি আরও জানান, ভবিষ্যতে গাছ গ্রুপ এই সংস্কার বিরোধী প্রচলিত নিয়ম নিয়ে জনমত গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে পারে।
এই পদক্ষেপ শাস্ত্রসম্মত এবং পরিবেশ সচেতন:
সনাতন ধর্মে গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। গৃহপ্রবেশের সময় গাছপালা ও প্রাণীদের ধ্বংসের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও প্রায়শ্চিত্ত করার বিধান রয়েছে। শাস্ত্র অনুযায়ী, শ্রাদ্ধ কখনোই আনন্দের উৎসব নয়, বরং তা আত্মশুদ্ধির এক উপলক্ষ। অরূপবাবুর এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সমাজে একটি ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে দেয়—আত্মীয় খাওয়ানো নয়, পরিবেশ ও সমাজের জন্য কিছু করা মা–বাবার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা।
এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যা আমাদের ভাবতে শেখায়—সংস্কার মানে কেবল প্রচলিত রীতি নয়, বরং বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে বিবেচিত শুভ কাজই প্রকৃত সংস্কার।