আবহাওয়া দক্ষিণবঙ্গ শিক্ষা লাইফ স্টাইল স্বাস্থ্য ভ্রমন ধর্ম কৃষি কাজ ক্রাইম

ইস্কুলের বাক্স বা ক্লাউডের মেঘ

By krishna Saha

Published :

WhatsApp Channel Join Now

ইস্কুলের বাক্স বা ক্লাউডের মেঘ

ঋষিগোপাল মণ্ডল
——————

আমরা যারা পাতি বাংলা মিডিয়ম , আমরা যারা মাধ্যমিকে কম নম্বর বলে সায়েন্স আমাদের কাছে আসেনি , তারা অনেকেই অমলেটকে মামলেট আর স্কুলকে ইস্কুল বলি।

এই সব ইস্কুলে ছোট বেলায় অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স থাকতো। বাক্সের একেবারে তলায় চাঁদমামা। তার উপরে যে ক্লাস টিফিনের পর , তার বই খাতা।একেবারে উপরে ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড ফোর্থ ক্লাসের বই আর খাতা। তখন দিস্তা পাতা কিনে গুনসূচ আর শঙ্খমার্কা সাদা সুতো দিয়ে সেলাই করে খাতা বানিয়ে দিত মা। আর ছিল ‘বঙ্গলিপি’ খাতা। সাদা মলাটে পশ্চিমবঙ্গর মানচিত্র। মানচিত্রের উপর দিকে একটা খোলা খাতার ছবি। সেই ছবির খাতার দুই পাতায় লেখা ‘বঙ্গ’ আর ‘লিপি’। রেশনেও কখনও বা দিত সেই খাতা। তখন রেশন ও মানুষ ও ইন্ডিয়া ডিজিটাল হয়নি।

অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সকে আড়াআড়ি দুই ভাগ করে বই খাতা থাকতো। মানুষের তখন মোবাইল ছিল না। মোবাইলে ধারবাকির হিসেবের জন্য খাতাবুক ছিল না। শনিবার বাক্স একটু খালি থাকতো। টিফিনে ছুটি। বাক্স খুললেই ঢাকনার ডালার ভিতর দিকে রুটিন লাগানো থাকতো আঠা দিয়ে। বই খাতা কিনলে পুস্তকালয়গুলো তখন রঙিন কাগজের রুটিন আর নেমপ্লেট দিত। বিলকুল ফ্রি। নেম , ক্লাস , সেকশন , সাবজেক্ট ফিলআপ করে নিলেই পৃথিবীটা একটা নতুন ক্লাসরুম হয়ে যেত। ক্লাসরুমের জানালার ওপাশে একটা পুকুর। পুকুরে ঝুঁকে থাকা নারকেল গাছ। গাছের পাতায় হাতছানির শিরশিরানি। এখন তো তোমরা উইন্ডো বলতে শপিং আর চ্যাটিংয়ের হাতছানি বোঝো , বলো!

বাবিন নামের এক বন্ধুবালক ইস্কুলের সেই বাক্সে পুচকে তালা দিয়ে রাখতো। ওর বাক্সে স্পাইডারম্যানের স্টিকার , সুগন্ধী , ডাস্টফ্রি গোলাপি প্রজাপতির মতো ইরেজার , ইরেজারপুচ্ছওয়ালা পেনসিল আর সুইচওয়ালা পেন থাকতো। লালনীলসবুজকালো চার রঙেই লেখা যেত অই কলমে। এমন কত দামি দামি জিনিস থাকতো বাবিনের অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে ! তালা দিয়ে রাখার মতো দামি ছিল বাবিনের বাক্স। স্যর রোলকলের সময় ববিনের কাছ থেকেই পেন নিয়ে প্রেজেন্ট-অ্যাবসেন্ট করতেন। শুধুমাত্র বড়লোক ছিল বলে বাবিনকে আমরা অনেকেই হিংসে করতাম। তবুও বাবিন একবার আমায় একটা খাপযুক্ত শার্পনার দিয়েছিল লুকিয়ে। ওটায় কাঠপেন্সিল ছুঁললে ছিলকাগুলো নিচে পড়তো না। কি যে অবাক হয়েছিলাম আমি ; এমনও অজুবা হয় এই গরিব দুনিয়ায়!

See also  খন্ডঘোষে দ্বিতীয় ধাপে শুরু হল দুয়ারে সরকার ক্যাম্প

বাবিনের বাক্সে থাকতো রুপোলি ফয়েলে মোড়া পনির রোল , স্যান্ডউইচের টিফিনবক্স। আমাদের টিফিনবক্সে মুড়ি গুড় চনাচুর আর মোটা আটার রুটিতে চিনি দিয়ে মোড়ানো মিছিমিছি রোল। পরে বুঝেছিলাম আমাদের রোল আসলে বাবিনের রোলের রোলে অভিনয় করতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। হেরে যাচ্ছে বারবার। আমরা টিফিন খেলে কত বিচ্ছিরি শব্দ হতো। কই , বাবিন টিফিন খেলে তো এত শব্দ হয় না!

বাবিনের সঙ্গে পেরে না ওঠার কষ্ট , বাবিনের কাছে হেরে যাওয়ার কষ্টের যে ছেলেবেলার ইস্কুল , সেখানে ছুটির ঘন্টা বাজাতো যে বাহাদুর , তার দেশের বাড়ি সিকিমের এক গ্রামে। গ্রামটা আক্ষরিক অর্থেই খাদের কিনারে। সেই মরণের মতো শ্যামসমান কুহককিনারে বারান্দাওয়ালা একটা বাড়িতে হোমস্টে চালায় বাহাদুরের বড় নাতি। আমার ইস্কুলে আর কোনও বাহাদুর নেই। লোয়ার ডিভিশন কেরানীই সুইচ টিপে ছুটির ঘন্টা দেয়। চারপাশ কেরানীতে ম’ম’ করছে রে অনির্বাণ।

‘স্পেস’ নেই বলে ব্রেকআপ বিচ্ছেদ ডিভোর্স করে দিচ্ছে যে মানুষ , স্পেসস্টেশন থেকে পৃথিবীতে হেঁটমুন্ডঊর্ধ্বপদ সেল্ফি পাঠাচ্ছে যে মহাকাশচারী…তাদের আমি কিছুতেই বলিনা কোন ইস্কুলের কোন ক্লাসরুমের কোন বেঞ্চে কম্পাসের কাঁটা খোদাই করে লেখা আছে আমার আর বাবিনের কিছু সাংকেতিক গোপন কোড ল্যাঙ্গুয়েজ। আমি আর বাবিন ছাড়া কেউ তার পাঠোদ্ধার করতে পারবে না কোনদিন।

স্পেস নিয়ে মানুষের ঝঞ্ঝাট , স্পেস নিয়ে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের গবেষণার মাঝে ইস্কুল খুলে যাচ্ছে এবার। ইস্কুলগামী
মানুষের বাচ্চারা আর অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স নেয় না। ওদের সকলের ব্যাকপ্যাক। পিঠে বোঝা।

আমাদের ইস্কুল বাবিনের অই তালা দেওয়া অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে আর কাঠের বেঞ্চের কোড ল্যাঙ্গুয়েজের ক্লাউডে আছে।

আমি মেঘকে মেঘ বললেও তোমরা অনেকেই তো ক্লাউডকে স্পেস বলো , বলো!

krishna Saha

আমার নাম কৃষ্ণ কুমার সাহা, আমি ফুল টাইম সাংবাদিকতা করি।গত ৮ বছর ধরে এই পেশায় আছি