
জন্মের সময় থেকেই নেই দুটি হাত।তাই সাধ থাকলেও প্রভু জগন্নাথ দেবের রথের রশি টানতে পারেন না প্রতিবন্ধী শিক্ষক জগন্নাথ বাউরী।তবে পূর্ব বর্ধমানের আউসগ্রামের এই জগন্নাথ রথের দিন প্রভু জগন্নাথদেব স্মরণে ব্রতী হতে ভোলেন না
।তবে রথ উৎসবের দিন প্রভু জগন্নাথ দেবের রথের রশি টানতে না পারাটা এই জীবন্ত জগন্নাথ কে বড়ই বেদনাতুর করে তোলে।
রাজ্যের এক জঙ্গলমহল হিসাবেই আউসগ্রামের পরিচিতি। সেই আউসগ্রাম ১ ব্লকের বেরেন্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের বেলুটি গ্রামে বাড়ি বছর ৪৫ বয়সী জগন্নাথ বাউরীর। তিনি বাড়ির বড় ছেলে। তাঁর ছোট ভাইয়ের নাম বলরাম। জগন্নাথ বাবু জানান, জন্মের সময় থেকেই তাঁর দুটি হাত নেই। তা দেখে
তখন থেকেই তাঁদের গ্রামের লোকজন প্রভু জগন্নাথ দেবের সঙ্গে তাঁর তুলনা করতে শুরু করেন। এমনকি তাঁর বাবা লক্ষণচন্দ্র বাউরী ও মা সুমিত্রা বাউরীও মনে করতেন তিনি প্রভু জগন্নাথ দেবের’ই আশীর্বাদধন্য। তাই দুটি হাত না থাকলেও সমস্ত প্রতিকুলতাকে উপেক্ষা করে একদিন না একদিন তিনি নিজের পায়ে দাঁড়াবেন এমনটা বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল তাঁর বাবা-মায়ের ।
জগন্নাথ জানান,সেই বিশ্বাসেকে আঁকড়েই তাঁর বাবা শৈশবেই তাঁকে বেলুটি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে নিয়ে যান।তখন তাঁক দেখে
ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভূতনাথ পাল মহাশয় তাঁর বাবাকে বলেন ,’প্রভু জগন্নাথ দেবকে স্মরণ করে তোমার ছেলের নাম রাখো জগন্নাথ। তাঁর বাবা প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের সেই উপদেশ মেনে নেন। এরপর থেকে জগন্নাথ বাউরী নামেই তাঁর পরিচিতি হয়। ওই নামেই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু হয় তাঁর লেখাপড়া জীবন।
যুগ ও সময় বদলের সাথে তাল মিলিয়েই বদলেছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ধরন ধারণ।কিন্তু তার জন্য বিশ্বাস ও ভক্তি ভাবে কোনও বদল আসেনি বাউরী পরিবারে। জগন্নাথ বাউরী যখন
ছোট তখন তাঁর বাবা ও মা খেতমজুরির কাজ করতেন। তা থেকে পাওয়া সামান্য পারিশ্রমিকে
কোন রকমে তাঁদের দিন গুজরান হত।তবুও প্রভু জগন্নাথ দেবের প্রতি তাঁদের ভক্তিভাবে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়ে নি।সেই সময় থেকে আজও, দিন আনা দিন খাওয়া বাউরী পরিবারের সকলে সব কাজে প্রভু জগন্নাথ দেবেকেই স্মরণ করেন।ভরসাও রেখে চলেছেন প্রভু জগন্নাথ দেবের উপরে।
দু হাত না থাকা সত্ত্বেও লেখা পড়া শিখতে পারার জন্য বেলুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভূতনাথ পালের প্রতি আজও শ্রদ্ধাশীল জগন্নাথ বাউরী। তিনি জানান, তাঁর পা ধরে পায়ে পেন্সিল গুঁজে দিয়ে তাঁকে বাংলা ও ইংরেজি অক্ষর লেখা শিখিয়ে ছিলেন শিক্ষক ভূতনাথ পাল। পায়ে করে লেখা শিখতে পারার পরেই তাঁর লেখাপড়া শেখার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। এরপর থেকে শত কষ্টের মধ্যেও তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যান। সাফল্যের সঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি ’বেসিক ট্রেনিং’ কোর্সে ভর্তি হন। ট্রেনিং সম্পূর্ণ হওয়ার পর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি পান।সেই
থেকে প্রায় ১৫ বছর হল তিনি আউসগ্রামের জয়কৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।
জগন্নাথ বাউরি যে স্কুলে শিক্ষকতা করেন সেই স্কুলটি তাঁর বাড়ি থেকে ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। জগন্নাথ বাবু জানান ,’পায়ের আঙুলে ’চক পেনসিল ’ গুঁজে নিয়ে তিনি পায়ে করেই বোর্ডে লিখেই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের পড়া বোঝান । তা নিয়ে কোনও অবিভাবক বা পড়ুয়া কেউ কোনদিন আপত্তি তোলে নি । বরং তারা তাঁর পড়ানোটাকেই মান্যতা দিয়েছেন’।বিদ্যালয়ের সহকর্মী ও ছাত্র-ছাত্রীরাও সকলে তাদের প্রিয় জগন্নাথ স্যারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শুধু স্কুলে দায়িত্বের সঙ্গে পড়ানোই নয়, জগন্নাথ বাউরী তাঁর সংসার জীবনের দায়দায়িত্বও যথাযথ ভাবে পালন করেন।স্ত্রী লক্ষী, বাবা, মা, ভাই ও বোনকে সবাইকে নিয়ে জগন্নাথের ভরা সংসার।
এই বাউরী পরিবার প্রতি বছর রথযাত্রা উৎসবের দিনটি ভক্তি সহকারে পালন করেন। জগন্নাথ বাউরী আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন , প্রভু জগন্নাথ
দেবের দুটি হাত নেই। একইভাবে জন্মের পর থেকে তাঁরও দুটি হাত নেই। তিনি দেবতা জগন্নাথদেব নন। তবে তাঁর শারীরিক গঠন জগন্নাথ দেবের মতোই। তাই জ্ঞান হবার পর থেকে প্রভু জগন্নাথ দেবকে তিনি তাঁর আরাধ্য দেবতা বলেই মেনে আসছেন।সেই কারণে প্রতিবছর রথযাত্রা উৎসবের দিনে তিনি প্রভু জগন্নাথ দেবের প্রতি ভক্তি নিবেদন করে প্রার্থনা করেন।জগন্নাথ বাবুর
আক্ষেপ,’প্রভু জগন্নাথ দেবের বড় বক্ত হয়েও দুটি হাত নেই বলে তিনি রথের রশি টানতে পারেন না।এই বিষয়টি তাঁকে বড়ই ব্যাথিত করে।আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন,“অনেক সাধ থাকলেও রথের রশি টানার বাসনা এই জীবনে তাঁর পূরণ হবে না। প্রতি বছর রথের দিন এই বিষয়টাই তাঁকে বড় বেদনাতুর করেতোলে।“