আবহাওয়া দক্ষিণবঙ্গ শিক্ষা লাইফ স্টাইল স্বাস্থ্য ভ্রমন ধর্ম কৃষি কাজ ক্রাইম

শতাধিক লেখকের জবানিতে প্রস্ফুটিত এক মানবতাবাদী

krishna Saha

Published :

WhatsApp Channel Join Now

কোনও জীবনীগ্রন্থ সম্পাদনা করা যে কত দুরূহ তা বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য নিমাইসাধন বসুর প্রয়াণের পর ‘হে মহাজীবন’ নামাঙ্কিত এক নাতিদীর্ঘ জীবনীগ্রন্থ সম্পাদনার ভার পেয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। একটি ব্যাপারে আমি চাপমুক্ত ছিলাম। ওই গ্রন্থে কারা লিখবেন তা পরিবারের পক্ষ থেকে স্থির করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যে সমস্যার মুখোমুখি হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম, তা হল সব লেখকের লেখাতেই একই কথা এবং তথ্য বারেবারে ঘুরেফিরে আসবেই। কে জীবনের কোন দিক নিয়ে লিখবেন তা পই পই করে বলে দেওয়া সত্বেও এই ধরনের গ্রন্থে দ্বিরুক্তি এড়িয়ে চলা পহেলগাঁও এর ঘাতকদের খোঁজার মতোই কঠিন এবং কিছুটা দু:সাধ্যও। ফারুক আহমেদ সম্পাদিত ‘উদার আকাশ’ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত ‘মোস্তাক হোসেন: জীবন ও ঐতিহ্য’ শিরোনামাঙ্কিত ৭২০ পৃষ্ঠার আকরগ্রন্থটিও এই সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। মোস্তাক হোসেন এই বাংলার বিরলের মধ্যে এক বিরলতম ব্যক্তিত্ব। তিনি সফল শিল্পপতি। জিরো থেকে হিরো হওয়া মানুষ। হর্ষবর্ধনের মতো দানবীর।


বৈভবের ঐশ্বর্য অনেকেরই থাকে। এই বাংলাতেই দশ-কুড়ি হাজার কোটি টাকার মালিক কম নেই। কিন্তু নিজের উপার্জনের টাকা ভালো কাজে অকাতরে দান করার লোক দূরবীনে চোখ রেখে খুঁজলেও মেলা দুষ্কর। তিনি তেমনই এক ব্যক্তি। আজকাল তো নর্দমা সংস্কার করেও ঘটা করে সাংবাদিকদের ডেকে ছবি তুলে উদ্বোধন করে নাম কেনা হয়। এই বাজারে মোস্তাক হোসেন কখনও শিক্ষার উন্নয়নে, কখনও বন্যাত্রাণে, কখনও গরিব মানুষের সাহায্যে, কখনও সংবাদ-পত্রপত্রিকার নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশে কোটি কোটি টাকা নীরবে বিলিয়ে চলেছেন। অত্যন্ত প্রচারবিমুখ এই ব্যক্তি যখনই বুঝতে পারেন তাঁর গুনপনার তারিফ করে সংবর্ধনা দেওয়া হবে তখনই সযত্নে সেই অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘যার আত্মা বড় তিনিই মহাত্মা। যাদের আত্মা ছোট, বিষয়ে বদ্ধ, টাকাকড়ি, ঘরসংসারের চিন্তায় যাদের মন আচ্ছন্ন, তারা দীনাত্মা।মহাত্মা তিনিই যিনি সকলের দু:খ-সুখ আপনার করে নিয়েছেন’। এই নিরিখে মোস্তাক হোসেন মহাত্মাও। এহেন মানুষের জীবনকাহিনি যে রেড রোডের মতো সরল এবং মসৃণ হবে না, থাকবে অনেক বাঁক, উত্থান, পতন, পুনরুত্থান তা বলা বাহুল্য।

সমাজের বিভিন্ন দিকের গুণী ব্যক্তিদের লেখনিতে এই গ্রন্থ হয়ে উঠেছে এক লিখিত তথ্যচিত্র। ১২০ জন লেখকের নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচ্ছুরণ এর সমাহার এই গ্রন্থ। কে লেখেন নি? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী সুরজিৎ দাশগুপ্ত থেকে শুরু করে ইবনে ইমাম, আবদুর রাকিব, খাজিম আহমেদ, অশোক দাশগুপ্ত, কবীর সুমন, মইনুল হাসান, আহমদ হাসান ইমরান, এমদাদুল হক নূর প্রমুখ। প্রায় একশো লেখকের রচনায় যেমন বারেবারে মোস্তাক হোসেনের জন্মবৃত্তান্ত, পরিবারের কথা, ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা, তাঁর দানের কথার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, তেমন কিছু নতুন দিকও উন্মোচিত হয়েছে অনেক নিবন্ধে। তবু পুরো গ্রন্থটি খুঁটিয়ে পড়ার সুবাদে যত বেশি লেখকের লেখার নির্যাসটুকু বিবৃত করা যায় তা করার চেষ্টা করি। অশোক দাশগুপ্ত যথার্থই বলেছেন, জনসেবী শব্দটা একশোয় একশোভাগ মিলে যায় ওঁর সঙ্গে। খাজিম আহমেদ লিখেছেন, মোস্তাক হোসেন একজন ড্রিমার, ম্যান অফ ভিশন, প্রোজেক্ট মেকার, পারসুয়েডার, আখেরে এক কামিয়াব পারফর্মার। অধ্যাপিকা সৈয়দ তানভির নাসরিন লিখেছেন ‘নিশ্চিত যে, একদিন মোস্তাক হোসেনকে সমাজ ও বৃহত্তর বিশ্ব স্বীকৃতি দেবে।’ প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসান তাঁর অনবদ্য সাবলীল লেখনির মাধ্যমে মোস্তাক হোসেনের জীবনের এক স্নিগ্ধ ছবি এঁকেছেন। বিশিষ্ট সম্পাদক -সাংবাদিক আহমদ হাসান ইমরান তারাবীর নামাজ আয়োজনের মধ্য দিয়ে কীভাবে মোস্তাক হোসেন ধর্মপ্রাণময়তার শিখরে উঠে চলেছেন তা নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন।

ড. সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়, সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল, সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য মোস্তাক সাহেবের শিক্ষাবিস্তারে ভূমিকা তুলে ধরেছেন। শিক্ষাবিদ দেবাশিস পাঠকের রচনায় মোস্তাক সাহেবের পাত্রী দেখার কাহিনি গল্পের মতো মনে দাগ কেটে যায়। ড. অর্ণব সাহা বাঙালি মুসলমানদের ইতিহাস বিবৃত করে সেই পটভূমিতে মোস্তাক হোসেনের উত্থানের কথা লিখেছেন। সমাজকর্মী অমর ভট্টাচার্য যথার্থই লিখেছেন, এত যোগাযোগ সত্বেও মোস্তাক হোসেন কখনও রাজনীতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর কথা কল্পনা করেন নি। ডিজিটাল যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কীভাবে মোস্তাক সাহেব শিক্ষার উন্নয়নে ব্রতী তা ধরা পড়ে কৌস্তুভ চৌধুরির লেখায়। সাংবাদিক সাহানা নাগচৌধুরি মনে করেন, তাঁর দেখানো পথ ধরে ভাবী প্রজন্ম এগোলেই সার্থক হবে মোস্তাক হোসেনের স্বপ্ন। ড. মীর রেজাউল করিম, ড. রতন ভট্টাচার্য, মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. আমজাদ হোসেন, ড. প্রবীর ঘোষ রায়ের রচনাগুলি সুপাঠ্য, সুলিখিত এবং গবেষণাধর্মী। কলকাতার বাঙালি মুসলমানদের বাসস্থানের সমস্যার সুরাহায় মোস্তাক সাহেব যে ‘গিয়াস মঞ্জিল’ এর মতো আবাসন গড়ছেন তা জানা যায় মুজিবর রহমানের লেখায়।

সম্পাদক-কবি এমদাদুল হক নূর ইতিহাসের অন্ধকূপ থেকে যেমন অমূল্য সব রত্নসমান তথ্যের বিন্যাস ঘটিয়ে মোস্তাক সাহেবের জাতিধর্মনির্বিশেষে দানশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তেমনই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, আগামি ১০০ বছরেও আর একজন মোস্তাক উঠে আসবেন না। গবেষক ফারহা পারভিন ঠিকই লিখেছেন, বাঙালির অচলায়তনের গণ্ডি ভেঙেছেন মোস্তাক হোসেন। ড. সেখ আবু তাহের কামরুদ্দিন লিখেছেন, অর্থসম্পদের প্রাচুর্যে বসেও বিলাসিতা, ক্রোধ, হিংসা, অহংকার মোস্তাককে স্পর্শ করতে পারেনি। আমিনুল ইসলামের এই কথাটিও মনে দাগ কাটে, ‘দেশে সফল মানুষ অনেক, সার্থক মানুষ কম। তেমনই মোস্তাক হোসেন’। অধ্যাপক মুহাম্মদ সামসুল আলম মনে করেন, মানুষকে সাহায্য করতে পারাটাই মোস্তাকের কাছে শুকরিয়া। সোনিয়া তাসনিম, সমীর ঘোষ, হাফিজ মাহমুদ মুর্শিদ, ড. ঈশিতা সুর, কাজি খায়রুল আনম, মৌসুমী বিশ্বাস, মুজতবা আল মামুনের লেখাগুলি তথ্যসমৃদ্ধ এবং প্রশংসার দাবি রাখে। সামজিদা খাতুনের লেখায় মুসলিম সমাজের অনেক অকথিত দিক উঠে এসেছে। আইনজীবী আসাদুল্লাহ আল গালিব স্বীকার করেছেন, মোস্তাক সাহেবের বদান্যতায় তিনি হতদরিদ্র ঘরের সন্তান হয়েও উচ্চশিক্ষা নিয়ে ওকালতি করেছেন। অধ্যাপক ডালিম শেখ, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক কুমারেশ চক্রবর্তী অপূর্ব লেখনিতে মানবতাবাদী মোস্তাকের ছবি এঁকেছেন।

সামসুল আলম আবদুল লতিফ, ওবাইদুল্লাহ আল উবাইদি সোহরাওয়ার্দী এবং ফৈজুন্নেসা চৌধুরির সমাজ সংস্কারকাজের বর্ণনা দিয়ে একটি সুপাঠ্য লেখা লিখেছেন। ড. গৌতম নিয়োগীর লেখায় জানা যায়, মোস্তাক হোসেনের সাহায্যে কত শিক্ষার্থী সমাজের মুখ উজ্জ্বল করেছে। সেখ হাসান ইমাম কত বড় কথা একটি ছোট বাক্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘মোস্তাক হোসেনের তুলনা তিনি নিজেই’। ড. অজিত ত্রিবেদীর লেখাটি পড়লে এক পূর্ণাঙ্গ মানবতাবাদী শিল্পপতির ছবি ভেসে ওঠে। তথ্যচিত্র পরিচালক মজিবুর রহমানের লেখা পড়ে জানা গেল, কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণে কেমন অকাতরে দান করেছেন মোস্তাক সাহেব। আরফান আলি বিশ্বাস, গবেষক গোলাম রাশিদ, ড. মিতালি সরকার, কবি তৈমুর খান, আফসার হোসেন, মহ: শামিম ফিরদৌস, ইমরান মাহফুজ, দীপক সাহা, সৈয়দ রেজাউল করিম, আকমাম খান, এস এম সামসুদ্দিন, রণজয় মালাকার, ইলা দাস, সেখ নূর মহম্মদ, মধুবন চক্রবর্তী, সাবির আহমেদ, আবু রাইহান, তাজিমুর রহমান, আবু সাঈদ, খাদেমুল ইসলাম, সাবিনা সৈয়দ, সাংবাদিক আবদুল ওদুদ, সাংবাদিক প্রদীপ মজুমদার, কুতুবউদ্দিন আহমেদ ,

সামিমা মল্লিক, মহ: মতিউল্লাহ, শেখ সাদি মারজান, মো: হাসানুজ্জামান, অধ্যাপক সুরঞ্জন মিদ্দে, লালমিয়া মোল্লা, জহিরুল ইসলাম, সা’আদুল ইসলাম, ড. মুহাম্মদ আলি, ড. রমজান আলি, মুহাম্মদ মসিউর রহমান, মুহাম্মদ সামিম, আফতাবুজ্জমান, জ্যোর্তিময় সরদার, ড. শেখ কামালুদ্দিন, কালাচাঁদ মাহালি, এম হৃদয় হোসেনের নিবন্ধগুলি মানোত্তীর্ণ এবং ভিন্ন চিন্তার দিশারী। ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক ফারুক আহমেদও একটি বড় লেখায় মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন। গ্রন্থের শেষে মোস্তাক হোসেনের এক সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি রয়েছে। গ্রন্থের প্রচ্ছদ, লেখকসূচির ক্রমান্বয় এবং সামগ্রিক বিন্যাস যথাযথ। ইসলামের রীতি মেনেই মনে হয়, মোস্তাক হোসেনের কর্মময় জীবনের ছবি রাখা হয়নি। প্রুফের ভুল চোখে পড়েনি। সব মিলিয়ে এমন এক মহাজীবনের আক্ষরিক ডকুমেন্ট্রি নির্মাণের জন্য ‘উদার আকাশ’ এবং ফারুক আহমেদের নাম ইতিহাসে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে থাকবে।

See also  বাঁকুড়ার মুখ উজ্জ্বল করলো ইন্দপুরের শিল্পা, উচ্চ মাধ্যমিকে রাজ্যে সপ্তম।

krishna Saha

আমার নাম কৃষ্ণ কুমার সাহা, আমি ফুল টাইম সাংবাদিকতা করি।গত ৮ বছর ধরে এই পেশায় আছি