বাংলার পৌষ মানেই ‘লক্ষ্মী মাস’। পৌষ মানেই পিঠে, পার্বণ, মেলা, উৎসব, বনভোজন। ইংরেজি মাসের পঁচিশে ডিসেম্বর অর্থাৎ বড়োদিন ও ইংরেজির নববর্ষ বাংলার এই পৌষ মাসেই হয়ে থাকে। আবার এই মাসকে ঘিরে গ্রাম বাংলায় রয়েছে অনেক আচার, রীতি, নিয়ম। যেমন এই পৌষ মাসে কোনো বিবাহ হয় না। কারণ বাংলার ঘরের মেয়েকে লক্ষ্মী হিসাবে ধরে অন্যের বাড়ি (শ্বশুর বাড়ি) বিদায় জানাতে কোনো বাবা-মা’ই এই লক্ষ্মী মাসে চায় না, তাই এই মাসে বাংলা পঞ্জিকায় কোনো বিবাহের দিন থাকে না। গোটা মাস ধরেই বাঙালি শীতের আমেজ গায়ে লাগিয়ে নলেন গুড়ের সাথে পিঠে পুলির নানা স্বাদে রসনা তৃপ্ত করে থাকে ।
অগ্রহায়ন মাসে নতুন শস্য ঘরে তোলা হয়, তাই পৌষ মাসে গৃহস্থের ধানের গোলা, রান্নাঘরের ভাঁড়ার পূর্ণ থাকে। তাই এই মাসকে লক্ষ্মী মাস হিসাবে ধরে গ্রাম বাংলার মানুষ পৌষকে যেন বিদায় জানাতে চায় না। বিভিন্ন রীতি উপাচারের সাহায্যে পৌষকে যেন যেতে দিতে চান না, সারা বছর ঘরে আগলে রাখতে চান। তাই বলা হয় –
“এসো পৌষ যেও না জন্ম জন্ম ছেড়ো না,
আঁধারে-পাঁদারে পৌষ, বড়ো ঘরের কোণে বোস।
পৌষ এল গুড়ি গুড়ি, পৌষের মাথায় সোনার ঝুড়ি।”
বোঝাই যাচ্ছে পৌষ মাস আসবার সাথে সাথে ঝুড়ি বোঝাই করে নতুন শস্য, ফসল নিয়ে হাজির হয়। যদিও করোনার হানায় অনেকটাই হাত গুটিয়ে নিয়েছে কৃষকরা। তবুও গ্রাম বাংলার মানুষের যাতে সারা বছর গৃহস্থের ভাঁড়ার শস্যে পূর্ণ থাকে।
তাই পৌষের শেষ অর্থাৎ সংক্রান্তির দিন বিভিন্ন উপাচারের মাধ্যমে এই মাসকে আগলে রাখতে চায়। গ্রাম বাংলার অনেক জায়গায় একে ‘পৌষ আগলানো’ বলা হয়। যেমন বীরভূমে এবং বর্ধমানের অনেক গ্রাম অঞ্চলে পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন রাত্রিতে বা সংক্রান্তির দিন ভোরবেলায় গোবরের গোল নাড়ু (মণ্ড) তৈরি করে তার মধ্যে সিঁদুরের টিপ ও দুর্বা ঘাস গুঁজে দেওয়া হয়, সেই গোল মণ্ডগুলিকে তুলসী মঞ্চের সামনে, গোয়াল ঘরে, ধানের মোরাই বা গোলায়, ঠাকুর ঘরে, সদর দরজায় প্রভৃতি স্থানে নতুন চালের গুঁড়ি গোল করে মারুলি দেওয়ার মতো করে ছড়িয়ে দিয়ে তার মাঝখানে একটি এই গোবরের গোল মণ্ডকে রেখে মুলো ফুল ও সরষে ফুল দিয়ে বাড়ির গৃহস্থ মহিলারা শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনির সাহায্যে পুজো করে থাকে, এবং কার্তিক সংক্রান্তিতে নতুন ধান ঘরে তোলবার আগে আড়াই মুঠো ধান সমেত যে খড়ের আঁটিতে ‘মুট লক্ষী’ পুজো হয় সেই খড়ের একটি টুকরোও এখানে রেখে দেওয়া হয়। একে গ্রাম্য ভাষায় ‘পৌষ আগলানো’ বলে।
বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ৬ ই জানুয়ারী পূর্ব বর্ধমান জেলার অন্তর্গত দক্ষিণ দামোদর এলাকার বহু বাড়িতে ধন লক্ষীর আরাধনায় মেতেছে গৃহিনীরা। সকাল সকাল স্নান করে নতুন ধানের উপর পাতা হয় লক্ষীর পট সহ বিভিন্ন অনুসাঙ্গিক দ্রব্য। বিভিন্ন রকমের ফল মিষ্টি সহকারে পুরোহিত দ্বারা দেওয়া হয় পুজো। গৃহিনীরা উপবাস থেকে আরাধনায় মাতে। পুজোর পরে নিরামিষ আহার ভোজন করে সকলে। দক্ষিণ দামোদর এলাকার তোড়কোনা, বড়ো গোপীনাথপুর, কৈয়ড়, সেহারা সহ আরও অন্যান্য গ্রামে পূজিত হয় পৌষ মাসের এই দিনে মা লক্ষীর পুজো।