আবহাওয়া দক্ষিণবঙ্গ শিক্ষা লাইফ স্টাইল স্বাস্থ্য ভ্রমন ধর্ম কৃষি কাজ ক্রাইম

বর্ধমান রাজবাড়ির পতনের কারন ? খন্ড -৩

By krishna Saha

Published :

WhatsApp Channel Join Now

বর্তমানে একটি স্ত্রী নিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন ? ৮ জন স্ত্রী এবং একজন বিদেশিনী বান্ধবী সাথে নিয়ে রাজপরিবার পরিচালনা করেছিলেন বর্ধমানের মহারাজ তেজচাঁদ মহাতাব !বর্ধমান মহারাজ তিলক চাঁদের সময় বিবাহসূত্রে মহারানী ছিলেন দুইজন ! প্রথম স্ত্রী বিষ্ণু কুমারী দেবী এবং পুত্র ইতিহাস খ্যাত মহারাজ তেজচাঁদ বাহাদুর ! সুন্দরী দুই কন্যা তোতাকুমারী এবং চিত্র কুমারী !

বর্ধমান খোসবাগান পার্শ্ববর্তী রানিসায়ের দীঘিটি বিষ্ণু কুমারী দেবীর কৃষ্টি ! নিঃসন্তান দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ছিল রূপ কুমারী দেবী ! মহারাজ তিলক চাঁদের আমলেই লক্ষী নারায়ন মন্দির এবং ভুবনেশ্বর মন্দির নির্মিত হয়, সাথে সাথে বর্তমান বর্ধমান রাজপ্রাসাদ স্থাপনের কাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় ১৭৭১ সালে দুর্ভিক্ষের সময় রাজকোষ খালি রেখেই মৃত্যু হয় ! রাজবাড়ীর মূল্যবান জিনিসপত্র এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহায্য নিয়ে পিতার পারোলৌকিক ক্রিয়াকর্ম করেছিলেন পুত্র তেজচাঁদ !

নাবালক তেজচাঁদ কে সঙ্গে নিয়ে মা বিষ্ণু কুমারী দিল্লির বাদশাহ “শাহ আলমের” ফরমান নিয়ে রাজকার্য পরিচালনা করছিলেন ! নবাবহাট সংলগ্ন জায়গায় এক লক্ষ টাকারও বেশি খরচা করে একসাথে ১০৮টি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ! সারা ভারত বর্ষ থেকে প্রায় এক লক্ষ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত উপস্থিত থেকে দ্বার উদঘাটন করেছিলেন ! বাল্য মহারাজ তেজচাঁদ নিজে পণ্ডিতদের পা ধুয়ে দিয়েছিলেন ! প্রায় সারা বছরই এই ১০৮ শিব মন্দিরে বিভিন্ন রাজ্য থেকে যাত্রী পূজা দিতে আসেন এবং শিবরাত্রিতে মহা ধুমধাম করে পূজার্চনা হয় ! ১৭৭৯ সালে তেজচাঁদ সাবালক হলেন এবং ১৭৯৩ সালে ইংরেজ সরকার একটি আইন প্রণয়ন করলেন ও মহারাজের সঙ্গে চুক্তি হলো, রাজস্ব ধার্য বাবদ ৪০,১৫১০৯ সিক্কা এবং ১৯,৩৭২১ সিক্কা পুলবন্দী বাবদ চাই ! ফের দুর্ভিক্ষের জন্য নবাগত মহারাজ রাজস্ব মেটাতে পারলেন না এবং গুরুত্বপূর্ণ জমিদারির কিছু অংশ বিক্রি করে দিতে হলো সিঙ্গুরের দ্বারিকানাথ সিংহ, ভাস্তারা ছকু সিংহ এবং জনাই নিবাসী বন্দ্যোপাধ্যায় বংশের কাছে ! পরবর্তীকালে পত্তনি ব্যবস্থা চালু হতে তেজচাঁদ জমিদারি রক্ষা করতে পেরেছিলেন !

See also  লক্ষ্মীর ভান্ডার কে হাতিয়ার করে জয় গ্রামের গৃহবধূর

অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে ১৮১৭ সালে বর্ধমানে “ভার্নাকুলার স্কুল” স্থাপন করেছিলেন, পরবর্তীকালে মহতাব চাঁদ সংস্কার করে হাইস্কুল এবং ১৮৮১ সালে উন্নতি করে আই.এ.কলেজের রূপ দিলেন !তেজচাঁদ ভোগবিলাসী এবং নিত্য নৈতিক বিদেশি মদ্যপানে মগ্ন থাকতেন ! বাইজি বাড়িতে বন্ধুদের সাথে নিয়ে যাতায়াত করতেন এবং বহু অর্থ অপচয় করেছিলেন ! তিনি এক বিদেশিনি সঙ্গী ছাড়াও আটজন রানীকে জীবনসঙ্গী করেছিলেন !

লেখক চট্টোপাধ্যায় লিখছেন-বর্ধমানের বুড়া রাজা প্রতিদিন প্রাতে দেওয়ান, মোসাহেব ও অন্যান্য কর্মচারীরা অন্দরমহলের দ্বারে আসিয়া তেজচাঁদ বাহাদুরের বহির্গমন প্রতীক্ষা করিতেন ! তিনি যথাসময়ে এক স্বর্ণপিঞ্জর হস্তে বহির্গত হইতেন, পিঞ্জরে কতকগুলি লাল নামা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পক্ষী আবদ্ধ থাকিত ! তিনি তাহাদের ক্রীড়া ও কোন্দল দেখিতে দেখিতে আসিতেন ! সমুখবর্তী হইবা মাত্র তাঁহাকে সকলে অভিবাদন করিত, মহারাজা হাসিমুখে তাহাদের আশীর্বাদ করিতেন ! একদিন প্রাতে তিনি পিঞ্জর হস্তে অন্দরমহল হইতে বহির্গত হইতেছেন, এমন সময় একজন প্রধান কর্মচারী অগ্রসর হইয়া করজোড়ে নিবেদন করিল মহারাজ, হুগলিতে খাজনা দাখিল করিবার নিমিত্ত সে দিবস যে এক লক্ষ টাকা পাঠানো হইয়াছিল, তাহা তথাকার মোক্তার আত্মসাৎ করিয়া পলাইয়াছে ! তেজচাঁদ বিরক্ত হয়ে উত্তর করিলেন, চুপ ! হামরা লাল ঘবরাওয়েগা !

এক লক্ষ টাকা গেল শুনিয়া তাঁহার কষ্ট হইল না, কিন্তু কথার শব্দে লালপক্ষী ভয় পাইবে, এই জন্য তাঁহার কষ্ট হইল ! এই মনে করিয়া কর্মচারী বড় রাগ করিলেন, পাপিষ্ঠ মোক্তারকে সমুদয় টাকা উদগীরণ করাইব, নতুবা কর্মত্যাগ করিব এই সঙ্কল্প করিলেন ! মোক্তারের অনুসন্ধান আরম্ভ হইল ! কিছুকাল পরে সংবাদ আসিল যে, মোক্তার আপন বাটিতে বসিয়া পুষ্করিণী কাটাইতেছে, দেউল দিতেছে, আর যাহা মনে আসিতেছে তাহাই করিতেছে ! তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য রাজ্যসরকার হইতে সিপাহি ও হাওয়ালদার বাহির হইল ! কিন্তু রাজা তেজচাঁদ প্রথমে তাহা জানিতেন না; কিছুদিন পরে তাহা শুনিয়াছিলেন ! মোক্তার ধৃত হইয়া রাজবাটীতে আনীত হইলে তেজচাঁদ বাহাদুর মোক্তারকে জিজ্ঞাসা করিলেন .

See also  কেমন কাটবে আজ আপনার দিন

তুমি আমার এক লক্ষ টাকা চুরি করিয়াছ ?
মোক্তার–না, মহারাজ, আমি চুরি করি নাই, আমি তাহা বাটীতে লইয়া গিয়াছি !

তেজচন্দ্র–কেন লইয়া গেলে ?

মোক্তার–মহারাজের কার্যে ব্যয় করিব বলিয়া লইয়া গিয়াছি ! আমাদের গ্রামে একটিও শিবমন্দির ছিল না, কুমারীরা শিবমন্দিরে দীপ দানের ফল পাইত না, যুবতীরা শিবপূজা করিতে পাইত না !এক্ষণে মহারাজের পুণ্যে তাহা পাইতেছে ! আর, একটি অতিথিশালা করিয়াছি, ক্ষুধার্ত পথিকেরা এখন অন্ন পাইতেছে !

তেজচন্দ্র–তুমি কি সমুদয় টাকা ইহাতেই ব্যয় করিয়াছ ?

মোক্তার–আজ্ঞা না মহারাজা আমাদের দেশে বড় জলকষ্ট ছিল, গোবৎসাদি দুই প্রহরের সময় একটু জল পাইত না, আমি মহারাজের টাকায় একটি বড় পুষ্করিণী কাটাইয়াছি ! মহারাজের পুণ্যে তাহার জল কীরূপ আশ্চর্য পরিষ্কার ও সুস্বাদু হইয়াছে, তাহা সিপাহিদের জিজ্ঞাসা করুন !

তেজচন্দ্র–পুষ্করিণীটি প্রতিষ্ঠা করিয়াছ ?

মোক্তার–আজ্ঞা না! টাকায় কুলায় নাই !

তেজচন্দ্র–এখন কত টাকা হইলে প্রতিষ্ঠা হয় ?

মোক্তার–ন্যূনকল্পে আর দুই হাজার চাই !

তেজচন্দ্র–কিন্তু দেখো! খবরদার!–দুই হাজার টাকার এক পয়সা বেশি না লাগে, তাহা হইলে আর আমি দিব না !

তাহার পর পূর্বকথিত কর্মচারীকে ডাকিয়া মহারাজ বলিলেন, আমি তো মোক্তারের কোনও দোষ দেখিতে পাইলাম না ! মোক্তার যাহা করিয়াছে, তাহাতে আমার টাকা সার্থক হইয়াছে ! ইহা অপেক্ষা আমি আর কি ভালো ব্যয় করিতাম। কর্মচারী নিরুত্তর হইল !

বৃদ্ধ বয়সে তাঁকে দেখে অনেকে হাসাহাসি এবং মজা করত! মহৎ জীবন খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে যৌবনে তিনি একজন উচ্চাঙ্গের সাধক ছিলেন! তন্ত্রসাধক কমলাকান্তের সান্নিধ্যে আসেন এবং বর্ধমানের বোরহাটে “কমলাকান্ত” আশ্রম তৈরি করেন! বর্ধমানে প্রচলিত কাহিনি আছে কমলাকান্ত তেজচাঁদ মহারাজকে অমাবস্যার রাতে পূর্ণিমার চাঁদ দেখিয়েছিলেন এবং মদ্যপানের আসরে গ্লাসভর্তি মদকে দুধে পরিণত করেছিলেন! তার আমলেই বর্ধমান শহরে রাধাবল্লভ জিউ ও অন্নপূর্ণাদেবীর মন্দির বানানো হয়! কলকাতার পেনোপোস্তা, ওল্ডচিনাবাজার, টেরেটো বাজার শ্রীশ্রী রাধাবল্লভজিউর সেবায় দান করেন! বর্ধমানে অসম্পূর্ণ রাজপ্রাসাদটিও তিনি সম্পূর্ণ করেন! রাধাবল্লভ ঠাকুরের মন্দির সাধারণের আসা-যাওয়ার জন্য বাঁকা নদীর দক্ষিণ দিকে যে ভাঙা পুলটি ছিল সেটিকে সম্পূর্ণ সংস্কার করে একটি কংক্রিটের ব্রিজ তৈরি করেন! বর্তমানে আলমগঞ্জের সঙ্গে রাজবাড়ি যাতায়াতের প্রধান সেতু! রাজবাড়ীর বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে ষষ্ঠতম মহারানী কমলকুমারী ছিলেন সর্বদা পাশে!

See also  ভোট পরবর্তী রাজনৈতিক হিংসা মামলায় এবার অনুব্রত ঘনিষ্ট আউশগ্রামের তৃণমূল নেতাকে তলব করলো সিবিআই

অত্যাধিক নারীসঙ্গ কাটাতে, মায়ের নির্দেশে জাজপুর নিবাসী মহারানী জয়কুমারী দেবীর সাথে প্রথম বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন! তিন বছরের মধ্যেই উখড়ার উড়রমল শেঠের কন্যা প্রেমকুমারী হন বিবাহসূত্রে দ্বিতীয় রাজরানী! তৃতীয় মহারানি ফতেপুর নিবাসী লালা বাহাদুর সিংহের ভগিনীকণ্যা সেতাবকুমারী! চতুর্থ মহারানি তেজকুমারী দেবী!! (ক্রমশ)

ARTICLE PUBLISHED BY রথীন রায়

 আজ চতুর্থ রানী পর্যন্ত থাক,
আগামী 17/01/22 তারিখে চতুর্থ খন্ড প্রকাশিত হবে!!
আরো পড়ুন – বর্ধমান রাজবাড়ির পতনের কারন ? খন্ড -২

krishna Saha

আমার নাম কৃষ্ণ কুমার সাহা, আমি ফুল টাইম সাংবাদিকতা করি।গত ৮ বছর ধরে এই পেশায় আছি