শক্তি চট্টোপাধ্যায়, কৃষকসেতু : শৌখিন বা অপেশাদার যাত্রাদল ধীরে ধীরে পেশাদার হয়ে উঠছে । রুজি-রোজগারের পেশাদার দল নয় । অভিনয় ও প্রযোজনার পেশাদারিত্ব । বাঁকুড়া শহরের বিভিন্ন যাত্রাদল যাত্রাপালায় বারবার পেশাদারিত্বের প্রমান দিচ্ছে । এমনি এক অপূর্ব পেশাদারিত্বপূর্ণ অভিনয় দেখলেন জেলা ও জেলার যাত্রামোদী দর্শকরা । গত ১২ই জুলাই, শনিবার, ২০২৫ তারিখের সন্ধ্যায় বাঁকুড়া রবীন্দ্রভবনের আলোকিত মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল ঐতিহাসিক যাত্রাপালা ‘দেবী সুলতানা’। পালাটির রচয়িতা কিংবদন্তি পালাকার ভৈরবনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ।

নির্দেশনায় ছিলেন নবাব সমন্বয় চ্যাটার্জি । দৃশ্য পরিকল্পনায় ছিলেন হরিহর পাল । বাঁকুড়া আটচালা প্রযোজিত ঐতিহাসিক যাত্রাপালা দেখতে সন্ধ্যায় বাঁকুড়া রবীন্দ্রভবনে ভীড় করেছিলেন যাত্রামোদী দর্শকরা । মানুষের যাত্রাপালা দেখার উন্মাদনা ছিল তুঙ্গে । যাত্রার শুরুতেই প্রদীপ প্রজ্জ্বলন এবং কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষকে সম্মাননা জ্ঞাপনের পরপরই শুরু হয় যাত্রাপালাটি । প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন বাঁকুড়া অমরকানন শময়িতা মঠের অধ্যক্ষা পূজনীয়া ঋষিঋদ্ধা অনাহতা । বেদ ও উপনিষদের মন্ত্র উচ্চারণ করেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় ।

শুরু থেকেই প্রত্যেক অভিনেতা ও অভিনেত্রীর পেশাদারিত্বের অভিনয়ে গোটা রবীন্দ্রভবন বুঁদ হয়ে বসে থেকেছিল । শুরু থেকে শেষ অবধি পালাটির গতি কোথাও থামেনি । নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর ইসলাম প্রচারের প্রেক্ষাপটে তীব্র হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বে আকাশ হয়েছিল ভারী । সাহসিনী দেবী সুলতানা হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি হয়ে মুর্শিদকুলি খাঁয়ের বিরুদ্ধাচরণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল । পালাটিতে জমে উঠেছিল ধর্মীয় বিভেদ ও সংঘাতের দৃশ্যের পর দৃশ্য । উঠে এসেছিল দেবী সুলতানা এবং নবাব মুর্শিদকুলি খাঁয়ের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ ।

পালাটির একেবারে শেষে ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ দেবী সুলতানাকে কন্যার মর্যাদা দিয়েছিল । এসেছিল শান্তি । এসেছিল সম্প্রীতি । এই মিলন দৃশ্যে দর্শকদের চোখ দিয়ে জল নেমেছিল । ধর্মের সংঘাত মানুষকে অজ্ঞানের অন্ধকারে নিমজ্জিত করে । পালাটিতে বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করেন মুর্শিদকুলি খাঁ-দীপ্তেন্দু ষন্নিগ্রহী, সৈয়দ সুজাউদ্দিন-হারাধন ব্রহ্মচারী, সাদি খাঁ-সঞ্জীব বটব্যাল, হাজি মোল্লা শরাফ-দেবাশিস পাল, আলিবর্দি খাঁ-সুরজিৎ রায়, আবু কালাশ-তমাল চন্দ্র, কাফ্রি নিগার-শ্রীকান্ত মুখার্জি, মহম্মদ জান-প্রশান্ত বাঙ্গাল, উদয় নারায়ণ-মলয় বটব্যাল, অনন্ত নারায়ণ-গৌতম মালগোপ, আদিত্য নারায়ণ-সত্যাভাস ভট্টাচার্য, আনন্দ নারায়ণ-শিশুশিল্পী রৌণক মণ্ডল, আকতার আলি-পিন্টু মেটে, মুস্তাক আলি-শ্যামল মাজি, গগণদেব-পিনাকী গোস্বামী, নয়নচাঁদ-উত্তম দাস, ধুর্জটিমঙ্গল- নবাব সমন্বয় চ্যাটার্জি । স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করেন জিন্নতউন্নিসা-সমাপ্তি মিশ্র, জয়ন্তী-শম্পা চৌধুরী, আব্বাসী-নিতু পাল এবং দেবীর ভূমিকায় শাশ্বতী হালদার ।

অনেক দিন পর যাত্রাপালায় বিবেকের গান শুনলেন রবীন্দ্রভবনের দর্শকরা । বিবেকের গান ও অভিনয় করেন উত্তম ব্যানার্জি । বারবার হাততালিতে ফেটে পড়েছিল গোটা রবীন্দ্রভবন ।
শেষ দৃশ্যে প্রত্যেক দর্শকের চোখের জল নেমেছিল চিবুক বেয়ে । সাজসজ্জা ও সুরপার্টি বাঁকুড়া রঞ্জিত স্টোর । আলো বিশ্বকর্মা ইলেকট্রিকস । যাত্রার সূচনাপর্বে সুন্দর সঞ্চালনা করেন বিশিষ্ট শিক্ষক, আটচালার অন্যতম প্রধান ব্যবস্থাপক স্বরূপ কুমার পাল ।
যাত্রাপালাটি দেখে প্রতিক্রিয়া পাঠিয়েছেন বিশিষ্ট মানুষজন । ব্রজবাসী জয়দেব লিখেছেন-‘ঘন্টাধ্বনি পড়লো ঠিক সন্ধ্যা ছয় টায়। মঞ্চে পড়লো সুর, আলোর ধারায় আলোকিত মঞ্চ, সেই আলো উদ্ভাসিত রঙ্গমঞ্চে আব্বাসীর নিদারুণ ভয়ার্ত “ঠাকুরমশায়, ও ঠাকুরমশায় চিৎকারে / ডাকে শুরু হলো হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কালজয়ী যাত্রা ” দেবী সুলতানা “।’ বিশিষ্ট গবেষক, প্রাবন্ধিক ড. দয়াময় রায় লিখেছেন- ‘অভিনয়ে ইতিহাসের চরিত্র এবং ইতিহাসের সঙ্গে অনিষ্ট কাল্পনিক চরিত্রগুলি রূপদানের ক্ষেত্রে ১০০% সফল হয়ে উঠেছিল। অপেশাদার যাত্রাপালা মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে নারী চরিত্রে অভিনয়ের যে সামান্যতম সমস্যা থাকে এই যাত্রাপালায় তার ন্যূনতম সমস্যা তো ছিলই না বরং মহিলাশিল্পীরা প্রতিটি দৃশ্যে শুধু নয় প্রতিটি সংলাপে অভিব্যক্তিতে দারুণভাবে সক্রিয়তায় সঙ্গত করে গেছেন ।

এটি নায়িকা নাম প্রধান যাত্রাপালার ক্ষেত্রে অধিক পাওনা । ফলে বাঁকুড়া রবীন্দ্র ভবন প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের সম্মুখে মনোরঞ্জক সুন্দর উপস্থাপনা বহুকাল মনে থাকবে । এমনভাবে আস্বাদন করেছি যে, দেবী, আব্বাসী, মুর্শিদকুলি, খুর্শিদকুলি, আলীবর্দী, ধূর্জটিমঙ্গলসহ বেশিরভাগ চরিত্রই আমাদের বিমোহিত করে রেখেছিল । শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা জানাই আটচালা পরিবারের সকলকে এবং এই মঞ্চায়ন শিল্পের সাথে যুক্ত প্রত্যেক সংস্কৃতি কর্মীকে । বারে বারে আমাদের চোখের কোণ যে চিক্ চিক্ করে উঠেছে তা অস্বীকার করি কি করে !’