আবহাওয়া দক্ষিণবঙ্গ শিক্ষা লাইফ স্টাইল স্বাস্থ্য ভ্রমন ধর্ম কৃষি কাজ ক্রাইম

পূর্ব বর্ধমানের “জল জীবন মিশন” প্রকল্প: পাইপলাইন পৌছালেও জল মিলছে না, ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী

krishna Saha

Published :

WhatsApp Channel Join Now

বাড়ি বাড়ি পাইপ লাইন পৌছে দিয়ে “জিও ট্যাগিং’ করা হয়ে গেলেও বছরের পর বছর মিলছে না জীবন মিশনের জল-ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা

জাতীয় “জল জীবন মিশন’ প্রকল্পে বাড়ি বাড়ি পৌছে দেওয়া হয়েছে পাইপ লাইন। তাতে কল লাগিয়ে দিয়ে তার ’জিও ট্যাগিং’ পর্যন্ত করা হয়ে গিয়েছে।কিন্তু দিনের পর দিন – বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও ওই কল দিয়ে পড়ছে না জল।এ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মতই ক্ষুব্ধ পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর সহ বিভিন্ন ব্লকের বহু গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁদের কথায়,”জল জীবন মিশন” প্রকল্প থাকলেও জীবনে বাঁচার জলের আকাল বঙ্গের গ্রামে গ্রামে এখনও রয়েই গিয়েছে’।  

ভারতের প্রত্যেক গ্রামীণ এলাকার বাড়ি বাড়ি প্রতিদিন পরিষ্কার ও নিরাপদ পানীয় জল পৌছে দেওয়াই হল,এই প্রকল্পের মুখ্য উদ্দেশ্য।ভারত সরকারের ’জলশক্তি মন্ত্রক’ ২০১৯ সালে ’জল জীবন মিশন’ প্রকল্পের কাজের সূচনা করে। ২০২৪ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ যথাযথ ভাবে সম্পূর্ণ করার সময়সীমা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল।সেই সময়সীমা পেরিয়ে গিয়ে ক্যালেন্ডার স্বাগত জানিয়ে দিয়েছে ২০২৫ সাল কে।কিন্তু বঙ্গের অন্যান জেলার মত পূর্ব বর্ধমান জেলাতেও  প্রকল্পের কাজ এখনও সম্পূর্ণতাই পায় নি। 

সর্বশেষ পাওয়া তথ্য (ড্যাশবোর্ড প্রাপ্ত) অনুযায়ী, “জল জীবন মিশন প্রকল্পে বাড়ি বাড়ি পাইপ লাইনে পৌছে দেওয়ার কাজ পশ্চিমবঙ্গে ৫৪ শতাংশ সম্পূর্ণ হয়েছে।আর রাজ্যের জেলা গুলির নিরিখে এই কাজের অগ্রগতীতে শীর্ষে রয়েছে পশ্চিম বর্ধমান।কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে ৭০.৭৬ শতাংশ।সব থেকে পিছিয়ে রয়েছে পুরুলিয়া জেলা।এই জেলায় কাজ হয়েছে মাত্র ৩২.৪৫ শতাংশ“। আর জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের (পূর্ব বর্ধমান) দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী পূর্ব বর্ধমান জেলা ৭০.০০ শতাংশ কাজ সম্পূর্ন করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের রিপোর্ট  অনুযায়ী,“পূর্ব বর্ধমান জেলার  ২৩ টি ব্লকের ২১৫ টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার ২১৬৮ টি গ্রামের মোট জন সংখ্যা ৪২,৭৬,৬৫৫ জন, বাড়ি সংখ্যা ১১,২১,৫৮২ টি। তার মধ্যে ০৭,৮৩,০০৬ টি

Read more – বীর বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তের স্মৃতি রক্ষার্থে জাতীয় পতাকা সংগ্রহশালায় দিলেন তার কন্যা ভারতী দত্ত বাগচী

See also  একঝলকে দেখে নিন পূর্ব বর্ধমান জেলার আজকের করোনা পজিটিভের সংখ্যা

বাড়িতে এখনও পর্যন্ত জল জীবন মিশন প্রকল্পের  পাইপ লাইন সংযোগ পৌছে দেওয়া গিয়েছে“। 

শুধু তাই নয় ,জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতর এও  দাবি করেছে,“প্রকল্পের কাজের অগ্রগতীতে জেলার শীর্ষে রয়েছে পূর্বস্থলী ২ নম্বর ব্লক।এই  ব্লকের ৯২.২৮ বাড়িতেই নাকি পাইপ সংযোগ পৌছে গিয়েছে। সবথেকে পিছিয়ে রয়েছে জেলার গলসি ১ নম্বর ব্লক।এই ব্লকের মাত্র ২৮.২৮ শতাংশ বাড়িতে পাইপ সংযোগ পৌছেচে“।তবে যতটুকু কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে,তা নিয়েও অভিযোগ ওঠার শেষ নেই ।কারণ, বাড়ি বাড়ি পাইপ পছালেও তা থেকে জল মেলে না। 

এ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দপ্তরের প্রতি যারপরনাই অসন্তুষ্ট।সম্প্রতি নবান্নের বৈঠক থেকে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেন ,“ বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌছে দিতে প্রশাসন দায়বদ্ধ।শুধু বাড়ি বাড়ি পাইপ লাইন সংযোগ পৌছে দেওয়া মানেই কাজ শেষ নয়।ওই পাইপ দিয়ে নিয়মিত জল পড়ছে, সেটা নিশ্চিত করতেই হবে“। 

মুখ্যমন্ত্রী পাইপ লাইন দিয়ে নিয়মিত জল পড়ার 

বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা বলেও বাস্তবে সেটাই হয় না অভিযোগ করেছেন পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর ব্লকের একাধীক পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দারা।ব্লকের চকদিঘি পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান গৌরসুন্দর মণ্ডল বলেন,“জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতর দাবি করেছে,’বাড়ি বাড়ি পাইপ লাইন সংযোগ দেওয়ার কাজ জামালপুর ব্লকের ৯০.৬৬শতাংশ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।’জেলা প্রশাসন  জামালপুর ব্লকের আবুজহাটী ২ গ্রাম পঞ্চায়েতকে ’জল জীবন মিশন প্রকল্পে’ জেলার ’সজল গ্রাম পঞ্চায়েতের’ স্বীকৃতি দিয়েছে।অথছ একই ব্লকের বাকি ১২ টি পঞ্চায়েতের অনেক গ্রামের বাড়িতে বহুদিন আগে  ’জল জীবন মিশন’ প্রকল্পের পাইপ পৌছালেও জল আজও মেলে না।“ 

এই অভিযোগের বিষয়টি জেলাশাসক (পূর্ব বর্ধমান) আয়েষা রাণী এ কে জানানো হলে তিনি বলেন,“পাইপ সংযোগ পৌছে যাওয়া বাড়ি গুলিতে জল পৌছে দেওয়া নিশ্চিত করার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।সেটা করার চেষ্টা আমরাও চালিয়ে যাচ্ছি

।কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা এখনও রয়েছে।আস্তে আস্তে সমস্যার সমাধান হচ্ছে।“

জেলাশাসক এমনটা জালালেও বিষয়টিকে এত হালকা ভাবে নিতে চাননি জামালপুরের চকদিঘি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান গৌরসুন্দর মণ্ডল। 

এমন অবস্থা তৈরি হওয়ার জন্য তিনি পিএইচই (PHE) দফতরের বিরূদ্ধে একরাশ ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। চকদিঘি পঞ্চায়েতের  গোপিকান্তপুর গ্রামের বাসিন্দা গৌরসুন্দর বাবু জানিয়েছেন,’প্রায় চার বছর আগে তাঁদের গোপিকান্তপুর গ্রাম সংলগ্ন প্রাণবল্লভপুর এলাকায় তৈরি হয় জল জীবন মিশন প্রকল্পের পাম্প ও রিজারভার ট্যাঙ্ক।তারপর গোপিকান্তপুর ও তার লাগোয়া মণিরামবাটি,

See also  বিদ্যালয় শিক্ষকদের গৃহ শিক্ষকতার বিরুদ্ধে গৃহ শিক্ষক কল্যাণ সমিতির ডেপুটেশন

শেরগড়,ইলামবাজার প্রভৃতি গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে জলের পাইপলাইন পৌছে দিয়ে কল লাগিয়ে দেওয়া হয়। সাথে সাথে এইসব গ্রামের প্রত্যেক পরিবারের প্রধানের আধার কার্ডের নম্বর দিয়ে ’জিও ট্যাগিং’ও সেরে ফেলেন পিএইচই (PHE) দফতরের লোকজন’। ’জিও ট্যাগিং’ করার দিনই শুধুমাত্র ওই কল দিয়ে জল পড়েছিল। তার পর থেকে চার বছর পেরিয়ে গেলেও চারটি গ্রামের প্রায় ৩-৪ হাজার বাড়ির কেউ জল পাচ্ছে না ।গ্রীষ্মে এইসব গ্রাম গুলিতে জলের হাহাকার ছুটে যায়।তখন জলের জন্য এলাকায় থাকা অপরিচ্ছন্ন পুকুরের জল কিংবা চাষের জমির সাবমার্সিবলের উপরেই গ্রামগুলির মানুষজনকে নির্ভর করতে হয় “। 

জল না মেলা নিয়ে জামালপুরের জ্যৌৎশ্রীরাম,

জঁগ্রাম ও জামালপুর ২ নম্বর পঞ্চায়েত এলাকার  বাসিন্দারাও ক্ষুব্ধ । জ্যোৎশ্রীরাম গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম পাইকপাড়া ও জাঙ্গিরপুর।এইসব গ্রামের একটা বড় অংশের মানুষ পেশায় খেত মজুর। বাকিরা কেউ চাষবাস,আবার কেউ গরু ,ছাগল প্রতিপালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন।দারিদ্রতাকে সঙ্গী করেই তাঁদের দিন কাটে।  পাইকপাড়া গ্রামের বাসিন্দা চন্দনা রানা,কাজল পোড়েল সহ আরো অনেকে জানান, “প্রায় তিন বছর আগে তাঁদের গ্রামের প্রায় ১০০টি বাড়িতে জল জীবন মিশনের পাইপ সংযোগ দিয়ে কল লাগিয়ে দেয় পিএইচই (PHE) দফতরের লোকজন

। এরজন্য তারা কোনও বাড়ি থেকে ৫০ টাকা আবার কোন বাড়ি থেকে ১০০ টা করে  আদায় করেছিল।এরপর বাড়ির কর্তার আধার কার্ড নম্বর দিয়ে যেদিন জিও ট্যাগিং হয় সেদিই শুধুমাত্র ওই কলদিয়ে জল পড়েছিল।তার পর থেকে তিন বছর কেটে গেলেও জল আর মেলে নি।“চন্দনাদেবী বলেন,“গ্রীষ্মে আমাদের গ্রামে জল সংকট তীব্র আকার নেয়।তখন জলের জন্য আমাদের দূরের দামোদর নদ বা চাষের জমিতে থাকা সাবমার্সিবল থেকে জল সংগ্রহ করতে হয়।  

জাঙ্গিরপুর গ্রামের পাঁচটি পাড়ার তিন শতাধীক বাড়ির বাসিন্দারাও জল না পেয়ে ক্ষুব্ধ । গ্রামের বাসিন্দা সরমা মাঝি,রেণুকা মালিক ,পলাশ মালিকরা জানিয়েছেন,“জাঙ্গিরপুর গ্রামের তিন শতাধীক বাড়িতে জল জীবন মিশনের পাইপ লাইন ও কল বছরের পর বছর ধরে শুধুমাত্র অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।ওই কলের কার্যকারিতা কিছু নেই। জলের আকাল গ্রামে রয়েই আছে“।

See also  পশ্চিমবঙ্গে লকডাউন ৩১ শে অগস্ট পর্যন্ত

আদিবাসী অধ্যুষিত জামালপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েত অধীন জোড়বাঁধ হুজুকপাড়ার তিনি শতাধীক বাড়ির বাসিন্দারা সকলেই পেশায় ক্ষেত মজুর। গ্রামের বধূ তাপসী সিং ও কলাবতী মাহাতো জানিয়েছেন ,”প্রায় তিন বছর আগে তাঁদের গ্রামে

’জল জীবন মিশন’ প্রকল্পের পাইপ লাইন ঢোকে।তারপর বাড়ি বাড়ি জল পৌছে দেওয়ার জন্য পাইপ লাইন সংযোগ দেওয়া হয়।তাপসী সিং জানান ,’তাঁর বাড়িটি গ্রামের রাস্তার ধার থেকে একটু ভিতরে।তারজন্য পিএইচই (PHE) দফতরের

লোকজন তাঁর ’’বাড়িতে জল জীবন মিশন প্রকল্পের পাইপ লাইন সংযোগ দেওয়ার সমর ৭০০ টাকা নিয়েছিল“।অপর বাসিন্দা কলাবতী মাহাতো জানান,“একই কারণে তাঁর কাছ থেকে পিএইচই (PHE) দফতরের লোকজন ৬০০ টাকা আদায় করেছিল।এত টাকা নিয়ে বাড়িতে জলের পাইপ লাইন সংযোগ দেওয়া হলেও গ্রামে কারুর বাড়ির পাইপ দিয়ে জল পড়ে না বলে তাপসী ও কলাবতী জানিয়েছেন।“ 

জেলা বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রামকৃষ্ণ  চক্রবর্তী জানান,“জামালপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত গ্রাম কালনায় এলাকায় আমার বাড়ি।প্রায় দু’বছর আগে তাঁর বাড়ি সহ গ্রামের অন্য সকল বাসিন্দার বাড়িতে জল জীবন মিশন প্রকল্পে পাইপ লাইন সংযোগ দিয়ে জিও ট্যাগিং করে পিএইচই

(PHE) দফতরের লোকজন ।তারপর খুব বেশী হলে  সপ্তাহ খানেক ওই পাইপ লাইন থেকে জল 

মিলেছিল ।আর কোনদিন জল মেলে নি। পূর্ব বর্ধমান জেলায় এটাই “জল জীবন মিশন’ প্রকল্পের বাস্তব চিত্র বলে রামকৃষ্ণ চক্রবর্তি দাবি করেছেন।”

জেলাপরিষদের (পূর্ব বর্ধমান) জনস্বাস্থ ও কারিগরি দফতের কর্মাধ্যক্ষ বিশ্বনাথ রায় এই প্রসঙ্গে বলেন,“কিছু সমস্যার কারণে বাড়ি বাড়ি জল পৌছানো নিশ্চিত করা যায় নি ,একথা ঠিক। 

পাইপ লাইন পৌছে যাওয়া বাড়ি গুলিতে জল পৌছানো নিশ্চিত করতে ডিপার্টমেন্টকে নিয়ে আমরা সর্বত ভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি“। 

krishna Saha

আমার নাম কৃষ্ণ কুমার সাহা, আমি ফুল টাইম সাংবাদিকতা করি।গত ৮ বছর ধরে এই পেশায় আছি