আবহাওয়া দক্ষিণবঙ্গ শিক্ষা লাইফ স্টাইল স্বাস্থ্য ভ্রমন ধর্ম কৃষি কাজ ক্রাইম

মন থেকে জন্ম বলে তার নাম হয় ‘মনসা’

krishna Saha

Published :

WhatsApp Channel Join Now

 

রথীন রায় :- মনসা হলেন একজন লৌকিক হিন্দু দেবী ! দেবী ভাগবত পুরাণ সহ আরও অনেক পুরাণে দেবী মনসার উল্লেখ পাওয়া যায় ! তিনি সর্পদেবী, প্রধানত বাংলা অঞ্চল এবং উত্তর ও উত্তরপূর্ব ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে তার পূজা প্রচলিত আছে ! সর্পদংশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে, সর্পদংশনের প্রতিকার পেতে, প্রজনন ও ঐশ্বর্যলাভের উদ্দেশ্যে তার পূজা করা হয় ! মনসা ঘট স্থাপন করে পুজো করা হয় ! মনসা নাগ-রাজ (সর্পরাজ) বাসুকীর ভগিনী এবং ঋষি জরৎকারুর (জগৎকারু) স্ত্রী ! তাঁর অপর নামগুলি হল বিষহরি বা বিষহরা, নিত্যা ও পদ্মাবতী ! পুরাণ অনুসারে, মনসার হলেন শিবের স্বীকৃতকন্যা ও জরৎকারুর পত্নী ! জরৎকারু মনসাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ! মনসার মা চণ্ডী (শিবের স্ত্রী পার্বতী) তাঁকে ঘৃণা করতেন কিন্তু পরবর্তীতে মাতা চণ্ডী মনসাকে নিজের মেয়ের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন !

 

কোনো কোনো ধর্মগ্রন্থে আছে, শিব নয়, ঋষি কাশ্যপ হলেন মনসার পিতা ! মনসাকে ভক্তবৎসল বলে বর্ণনা করা হলেও, যিনি তাঁর পূজা করতে অস্বীকার করেন, তাঁর প্রতি তিনি নির্দয় ! জন্ম-সংক্রান্ত কারণে মনসার পূর্ণ দেবীত্ব প্রথমে অস্বীকার করা হয়েছিল ! তাই মনসার উদ্দেশ্য ছিল দেবী হিসেবে নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করা এবং একটি একনিষ্ঠ মানব ভক্তমণ্ডলী গড়ে তোলা ! তাঁর সাথে মিশরীয় দেবী আইসিসের মিল রয়েছে ! মনসা, কেতকা, পদ্মাবতী এই নামেই মনসাদেবী সমধিক প্রসিদ্ধ ! ইনিই মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ! তাই এই কাব্যকে মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ বলে ! মনসা প্রাক্-পৌরাণিক দেবী ! ইনি প্রাচীন পুরাণে স্থান পাননি অথচ লোকব্যবহারে ও লোকসাহিত্যে অর্বাচীন বৈদিককাল থেকে বিভিন্ন রূপ পরিবর্তন করে চলে আসছেন !

 

অবশ্য কোন কোন প্রাচীন হিন্দু পুরাণ ও বৌদ্ধ গ্রন্থের সর্প দেবী মনসার বর্ণনা আছে ! পদ্মাপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও দেবীভাগবতে মনসার উল্লেখ রয়েছে ! সংস্কৃত পুরান সাহিত্যে মনসা একবার ঈষৎ ধরা দিয়েছিলেন ! সেটা মহাভারতের আদিপর্বে জন্মেজয়ের সর্পসত্রের পূর্বপ্রসঙ্গক্রমে, কিন্তু প্রাচীন পুরাণ ও মহাভারতে যে সর্ব দেবীর উল্লেখ আছে সেখানে তিনি হচ্ছেন জরৎকারু আস্তিক তাঁর ছেলে ! মহাভারতে মনসার ও তাঁর স্বামীর নাম একই জরৎকারু ! ‘মনসা’ দেবতার ভাবনা ঋকবেদের অজ্ঞাত ছিল না ! ঋগ্বেদের একটি শ্লোকে মনসা দেবীর ইঙ্গিত পাওয়া যায় ! পুরাণে তাকে ঋষি কাশ্যপ ও নাগ-জননী কদ্রুর কন্যা বলা হয়েছে ! খ্রিস্টীয় ১৪শ শতাব্দী নাগাদ মনসা প্রজনন ও বিবাহের দেবী হিসেবে চিহ্নিত হন এবং শিবের আত্মীয় হিসেবে শৈব দেবমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত হন ! কিংবদন্তি অনুসারে, শিব বিষ পান করার পর মনসা মধ্যে তা সঞ্চার হয় এবং ‘বিষহরা’ নামে পরিচিত হন ! মনসার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং তা দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে !

See also  দোলের পরদিন ঘটাকরে অনুষ্ঠিত হল বর্ধমানের জোড়া রাধাবল্লভের দোল উৎসব

 

ধীরে ধীরে মনসা-কেন্দ্রিক ধর্মীয় গোষ্ঠীটি শৈবধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয় ! ফলে শিবের কন্যা রূপে মনসার জন্মের উপাখ্যানটি রচিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শৈবধর্মও এই আদিবাসী দেবীকে মূলধারার হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্য ধারার অন্তর্ভুক্ত করে ! মনসার মূর্তিতে তাকে সর্প-পরিবেষ্টিত নারী রূপে দেখা যায় ! তিনি একটি হংস বা পদ্মের উপর বসে থাকেন, তার বাহন হাঁস ও সাপ ! চার হাত তার উপরের দুটি হাতে থাকে পদ্ম ও নিচের দুটি হাতে থাকে সাপ ! সাতটি সাপের ফনা তার মাথার উপর ছাউনির আকারে বিরাজ করে ! কোনো কোনো মূর্তিতে তার কোলে একটি শিশুকে দেখা যায় ! এই শিশুটি তার পুত্র আস্তিক ! তাকে ‘একচক্ষু-বিশিষ্ট দেবী’ বলা হয় ! মনসার মা চণ্ডী ক্রোধের বসে তার একটি চোখ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন ! মহাভারতে মনসার বিবাহের উপাখ্যানটি রয়েছে ! জরৎকারু নামে এক ঋষি কঠোর তপস্যা করছিলেন ! তিনি স্থির করেছিলেন যে, বিবাহ করবেন না ! একবার তিনি কয়েকজনকে একটি গাছ থেকে হেঁটমুণ্ড উর্ধ্বপদ অবস্থায় ঝুলতে দেখলেন ! তারা ছিলেন জরৎকারুরই পূর্বপুরুষ ! তাদের সন্তানসন্ততিগণ তাদের পারলৌকিক ক্রিয়াদি না করার কারণে তাদের ওই অবস্থা হয়েছিল !

 

 

তাই তারা জরৎকারুকে বিবাহ করে একটি পুত্রসন্তান উৎপাদনের পরামর্শ দিলেন, যাতে সেই পুত্র তাদের পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে তাদের মুক্তি দিতে পারেন ! বাসুকী তার ভগিনী মনসার সঙ্গে জরৎকারুর বিবাহ দিলেন ! মনসার একটি পুত্রসন্তান ছিল আস্তিক ! তিনি তার পূর্বপুরুষদের মুক্ত করলেন, এছাড়া রাজা জনমেজয় যখন সর্পকুল বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করছিলেন, তখন আস্তিক নাগ বংশকে রক্ষাও করেছিলেন ! পুরাণেই প্রথম মনসার জন্ম-সংক্রান্ত উপাখ্যানটি পাওয়া যায় ! পুরাণ মতে মনসা ঋষি কশ্যপের সন্তান তথা কাশ্যপ গোত্রজ ! উল্লেখ্য মঙ্গলকাব্যে শিবকে মনসার পিতা বলা হলেও , পুরাণে সেই তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায় না ! একবার সাপ ও সরীসৃপরা পৃথিবীতে উৎপাত শুরু করলে ঋষি কশ্যপ নিজের মন থেকে মনসা দেবীর জন্ম দেন !

See also  জামালপুর গ্রামরক্ষী বাহিনীর কালি পুজোর দেখা মিলছে তারাপিঠের তারা মা ও বামা খেপার

 

মন থেকে জন্ম বলে তার নাম হয় ‘মনসা’ ! সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তাকে সর্প ও সরীসৃপদের দেবী করে দেন ! মনসা তার মন্ত্রবলে পৃথিবীতে নিজের কর্তৃত্ব বিস্তার করেন ! এরপর মনসা শিবকে প্রসন্ন করেন ! শিব তাকে বলেন নারায়ণ প্রসন্ন করতে ! মনসার প্রতি প্রসন্ন হয়ে নারায়ণ তাকে সিদ্ধি নামক দৈবী ক্ষমতা প্রদান করেন ! ফলে দেবী হিসেবে মনসার কর্তৃত্ব সুবিদিত হয় ! কশ্যপ ঋষি জরৎকারুর সঙ্গে মনসার বিয়ে দেন ! জরৎকারু এই শর্তে মনসাকে বিবাহ করতে রাজি হয়েছিলেন যে , যদি মনসা তার কথার অবাধ্য হন, তবে তিনি মনসাকে পরিত্যাগ করবেন ! একবার মনসা জরৎকারুর নিদ্রাভঙ্গ করতে দেরি করেছিলেন ! এতে সেদিন জরৎকারুর পূজা করা হয়ে ওঠেনি ! এই ঘটনায় দুঃখিত হয়ে জরৎকারু মনসাকে ত্যাগ করেন ! পরে দেবতাদের অনুরোধে তিনি মনসার কাছে ফিরে আসেন এবং আস্তিক নামে এক পুত্রের জন্ম দেন !!

krishna Saha

আমার নাম কৃষ্ণ কুমার সাহা, আমি ফুল টাইম সাংবাদিকতা করি।গত ৮ বছর ধরে এই পেশায় আছি