রথীন রায় ;- বামাক্ষ্যাপা বীরভূম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন (জন্ম ১২ ফাল্গুন ১২৪৪, মৃত্যু ২ শ্রাবণ ১৩১৮ ) ছিলেন এক হিন্দু তান্ত্রিক ! তিনি তারাপীঠে বাস করতেন, তিনি দেবী তারার ভক্ত ছিলেন এবং তিনি দেবী তারাকে “বড় মা” বলে ডাকতেন ! মন্দিরের কাছে শ্মশানঘাটে সাধনা করতেন !
তারাপীঠ মন্দির ও মহাশ্মশানে সাধনা করেই তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন ! সাধক বামাক্ষ্যাপা ‘তারা মায়ের ছেলে’ নামেও লোকমুখে পরিচিত ! নানাবিধ অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে তাঁর জীবন জড়িয়ে আছে ! এক অলৌকিক আধ্যাত্মিক শক্তি নিহিত ছিল তাঁর মধ্যে ! কৈলাসপতি বাবা এবং স্বামী মোক্ষদানন্দের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি !

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারণকবি মুকুন্দ দাস, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বহু বিখ্যাত মানুষ বামার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন তারাপীঠে ! ১৮৩৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তথা ১২৪৪ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসের মহাশিবরাত্রির দিন বীরভূম জেলার তারাপুরের কাছে আটলা গ্রামে বামাক্ষ্যাপার জন্ম হয় ! তাঁর বাবার নাম সর্বানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম রাজকুমারী দেবী ! সর্বানন্দ ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ! গ্রামের ঘরে-ঘরে নিত্যপূজা এবং খুব সামান্য চাষের জমি থেকে যে ফসল পাওয়া যেত, তা থেকেই তাঁর সংসার চলত ! ছোটবেলায় বামাক্ষ্যাপার নাম ছিল ‘বামাচরণ’ ! রামচরণ নামে তাঁর একটি ছোট ভাই এবং জয়কালী নামে তাঁর এক বড় দিদি ছিলেন !
ছোটবেলা থেকেই বামাচরণ তাঁর বয়সী অন্যান্য ছেলেমেয়েদের থেকে স্বভাবে আলাদা ছিলেন ! সমবয়সীদের সঙ্গে মিলে খেলাধুলো করার থেকে তিনি মাটি দিয়ে নানারকমের দেব-দেবীর মূর্তি তৈরি ও সেই মূর্তি পূজা-অর্চনা করতে বেশি ভালোবাসতেন ! একটু বড় হলে তাঁর বাবা তাঁকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠিয়ে দেন ! বামার লেখাপড়ার প্রতি একেবারেই আগ্রহ ছিল না ! পাঠশালায় গিয়েও তিনি ঠাকুরের নাম করতেন, ফলে বামার প্রথাগত শিক্ষালাভ সম্পূর্ণ হয়নি ! বাবার সঙ্গে বামা প্রায়ই তারাপীঠে তারা মায়ের মন্দিরে যাতায়াত করেন ! সেই মন্দিরে সর্বানন্দ প্রায়দিনই বেহালা বাজাতেন এবং বামা শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন ! কখনো বা গানের তালে বামা নাচতেও শুরু করতেন, এইভাবে চলতে চলতে বামার প্রায়ই ‘সমাধি’ হতে থাকে ! কানের কাছে ‘তারা তারা’ নাম শোনালে তবে বামার সমাধি ভাঙে !
এইসব আচরণ দেখে সাধারণ মানুষ বামাকে ‘ক্ষ্যাপা’ বলতে থাকে ! ছোটবেলা থেকেই বামাচরণ তারা মায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন ! বামাচরণের যখন আঠারো বছর বয়স, তখন তাঁর বাবার মৃত্যু হয় ! সংসার চালাবার জন্য বামা কাজ খুঁজতে থাকেন ! কিন্তু বিশেষ লেখাপড়া জানতেন না বলে কেউ তাঁকে কাজ দিতে রাজি হন না ! অবশেষে মুহুটি গ্রামের জমিদার বাড়িতে কালীমন্দিরের ফুল তোলার কাজ পেলেন বামাচরণ ! কিন্তু কাজে বামার মন বসে না ! তাঁর অন্যমনস্ক ভাব দেখে মন্দির কর্তৃপক্ষ ফুল তোলার কাজ থেকে ছাড়িয়ে বামাকে রাখলেন ঠাকুরের ভোগ রান্না করার কাজে ! সেখানেও রোজই কিছু না কিছু ভুল করতে থাকেন বামাচরণ ! সবাই তাঁকে ‘পাগল’ বলতে লাগল ! শেষ পর্যন্ত জমিদার মশাই বামাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন ! বাড়ি ফিরে এলেন বামা, পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে পাওয়া সামান্য জমি-জমাতে চাষ করতে লেগে গেলেন, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সে বছর ফসল ভালো হল না !
নিরুপায় হয়ে রাজকুমারী দেবী বামাচরণ আর তার ভাই রামচরণকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেন ! মামার বাড়িতে গিয়ে গরু চরানোর দায়িত্ব পেলেন বামা ! দুই ভাইয়ের উপর ভীষণ অত্যাচার করতে থাকেন তাঁদের মামা ও মামী ! তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বামাচরণের পৈতৃক সম্পত্তি তাঁদের নিজেদের নামে লিখিয়ে নেওয়া ! সেখানে কয়েকদিন কাটানোর পর মামা-মামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বামা বাড়িতে ফিরে এলেন ! এরপর তারাপীঠ মহাশ্মশানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় তান্ত্রিক সন্ন্যাসী ব্রজবাসী কৈলাসপতি বাবা ও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ মোক্ষদানন্দের ! তাঁদের কাছে বামা একে একে শিখতে লাগলেন বেদ ও শাস্ত্রপাঠ ! এই সময় মায়ের অনুমতি নিয়ে গৃহত্যাগ করেন বামা ! কয়েকদিন পরে তারাপীঠ মহাশ্মশানে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসিয়ে বামাকে তান্ত্রিকমতে সন্ন্যাসে দীক্ষা দেন কৈলাসপতি বাবা !
কয়েকদিন সাধনা করার পর সিদ্ধিলাভ করেন বামাচরণ ! কথিত আছে তাঁর ইষ্টদেবী তারা মা নাকি স্বয়ং আবির্ভূতা হন তাঁর সামনে ! এরপর থেকে তিনি পরিচিত হন ‘বামাক্ষ্যাপা’ নামে ! কৈলাসপতি বাবা ও মোক্ষদানন্দের সঙ্গে কাশীধাম ও হরিদ্বার ঘুরতে যান বামাক্ষ্যাপা ! সেখানে তাঁর সঙ্গে মহান সাধক ত্রৈলঙ্গ স্বামীর পরিচয় হয় ! কাশী থেকে ফিরে আসার পর বামাক্ষ্যাপার মা রাজকুমারী দেবীর মৃত্যু হয় ! যোগবলে মায়ের মৃত্যুর কথা জানতে পেরে বামা উপস্থিত হন নিজের জন্মভূমি আটলা গ্রামে ! তাঁর ইচ্ছা ছিল তারা মায়ের পায়ের নিচে গর্ভধারিণী মাকে সৎকার করবেন ! শোনা যায়, এই ইচ্ছা পূরণ করার জন্য এক অলৌকিক কাণ্ড করেছিলেন বামাক্ষ্যাপা ! মায়ের মৃতদেহ পিঠের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে সাঁতার দিয়ে পার হয়েছিলেন বর্ষাকালের উত্তাল দ্বারকেশ্বর নদ !
তারাপীঠ মহাশ্মশানে তারা মায়ের পায়ের নিচে এভাবেই মায়ের সৎকার করেছিলেন বামাক্ষ্যাপা ! মায়ের শ্রাদ্ধের দিনও এমনই আরেকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছিলেন তিনি ! নিমন্ত্রিতরা খেতে বসার সময় আকাশে ভয়ানক মেঘ জমেছে দেখে নিজের হাতের একটি কঞ্চি দিয়ে সব অতিথিদের চারদিকে একটি গণ্ডি টেনে দিয়েছিলেন বামা ! শোনা যায়, সেদিন সারা গ্রাম বৃষ্টির জলে ভেসে গেলেও সেই গণ্ডির ভিতরে একফোঁটা জল ঢোকেনি ! আজ বিশেষ ধুমধাম করে জন্মতিথি পালিত হচ্ছে তারাপীঠ সহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে !!