গল্প –
প্রায়শ্চিত্ত
সুদীপা ব্যানার্জী
রাধামাধবের মন্দিরে পুজো দিতে গিয়ে পুজোর ফুল নিবেদন করার সময় অসাবধানতায় শিউলির হাত লেগে পড়ে গিয়েছিল সিংহাসনের উপর রাখা শালগ্রাম শিলাটি । শিউলি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি শালগ্রাম শিলা তুলে সিংহাসনে রাখতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে মন্দিরের নিত্য পুজারি ধীরেন চক্রবর্তী চেঁচিয়ে উঠলো হায় হায় হায় একি অলক্ষুণে কাণ্ড; ঘোর পাপ নেগেছে গো মন্দিরে । কি সব্বনাশ কি সব্বনাশ। বলি কে কোতায় আচো গো শিগ্গির এসো সবাই দেকো গো এই ছোটনোকের বিটি কি কাণ্ড ঘট্টেচে । ধীরেন বামুনের এরকম হাঁড়িচাচা গলার চিৎকার শুনে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে ছুটে মন্দিরে উপস্থিত হলো গাঁয়ের মানুষ ।
ধীরে ধীরে গোটা গ্রাম ভেঙে পড়লো মন্দির প্রাঙ্গণে । শিউলি জন্ম থেকেই বোবা তাই কোন কথা বলতে না পেরে থতমত খেয়ে এক কোনে দাড়িয়ে চোখের জল ফেলছে । গাঁয়ের সবাই ধীরেন চক্রবর্তী কে কি হয়েছে জানতে চাইলে সে কপাল চাপড়ে বললো ঘোর সব্বনাশ গো , ঘোর সব্বনাশ । এই ছোটলোকের বিটি শালগ্রাম শিলায় হাত দিয়েচে । যেকেনে মেয়ে মানুষের এই শালগ্রাম শিলায় হাত দেবার অদিকার টুকুন নেইকো সেকেনে এই শূদ্রের বিটি শালগ্রাম শিলা অপবিত্রি করে দিলে গো । ওরে পাপিষ্ঠা আমাদের বামুনের ঘরের বউ- ঝি গুলোরও এই শিলায় হাত দেওয়া নিষেদ । তুই কি করে এমন অনাছিষ্টি কাজ করলি বল দিকিনি ;
ভীড় ঠেলে শিউলির বাবা নিতাই এসে ধীরেন চক্রবর্তীর পা দুটো ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো ও ছোট মেয়ে ঠাকুরমশাই ।না বুজে একখানা ভুল করে ফেলেচে ওকে ক্ষ্যামা করে দিন এবারের মতো । ধীরেন এক ঝটকায় নিজের পা থেকে নিতাইয়ের হাত দুটো সরিয়ে একটু তফাতে গিয়ে বললো না না এটা কোন ছোটখাটো ভুল নয় । শালা শূদ্রের ব্যাটা শালগ্রাম শিলায় হাত দেবার ফল কি হয় তা জানিস ? সব ধ্বংস হয়ে যাবে । তোরা সবাই মরবি পাপে । দয়া করুন ঠাকুরমশাই দয়া করুন এই বলেই আবার নিতাই ধীরেন চক্রবর্তীর পা গুলো আবার ধরলো । ধীরেন এবার একটু নরম স্বরে বললো একটা উপায় আচে , কি উপায় চক্রবর্তী মশাই ? গোটা গাঁয়ের লোক বলে উঠলো ।
একটু গম্ভীর হয়ে চক্রবর্তী বললো এই বিটি কে পায়শচিত্তি করতে হবে । তবেই যদি নারায়ণের ক্ষোভ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় । তা নইলে কিন্তু এই বিটিও পাপে মরবে আর তার সাতে সাতে মরবে গোটা গাঁয়ের নোক । গাঁয়ের সবাই একসাথে নিতাই কে বললো ঠাকুরমশাই যা বলছেন তাই করো নিতাই । ঐ মেয়েকে দিয়ে পায়শচিত্তি করাও । তোমার মেয়ের ভুলের জন্যি তো আর আমরা পাপে ভুগতে পারিনা । ঠাকুর মশাই আপনি বলুন কি করতে হবে শিউলি কে । চক্রবর্তী বললো শোন নিতাই আজ রেতের বেলা তোর মেয়েকে আমার বাড়িতে পাটাস খন । বড়ো একখানা যজ্ঞ করতি হবে ।
আমার কতার খেলাপ যেন না হয় , তা হলেই কিন্তু —-
চক্রবর্তীর মুখের কথা শেষ না হতেই নিতাই বললো আজ্ঞে আপনি যেমনটা বললেন তেমনটাই করবো ঠাকুরমশাই ।হুমম এই বলে চক্রবর্তী মন্দির ছেড়ে চলে গেল । আস্তে আস্তে মন্দির খালি হয়ে গেল । রাতের বেলা চক্রবর্তীর কথা মতো মেয়ে শিউলি কে নিয়ে নিতাই গেল চক্রবর্তীর বাড়ি । একবার ঠাকুরমশাই বলে ডাক দিতেই চক্রবর্তী বেরিয়ে এসে বললো ও এয়েচিস তাহলে ।মেয়েকে নাইয়ে এনেচিস ত নিতাই ? আজ্ঞে হ্যাঁ ঠাকুরমশাই আপনি যেমনটি বলেচেন ঠিক তেমনটি করেই । আচ্চা তুই একন বাড়ি যা ভোর হলে মেয়েকে এসে নিয়ে যাস খন । নিতাই বলে বলচি ঠাকুরমশাই আমি কি একেনে থাকতে পারবোনি ? ওরে না রে বাপু না এটা হলো গিয়ে পায়শচিত্তি করার মহাযজ্ঞ। তুই একেনে থেকে কি করবি শুনি যাঃ দূর হ ।বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পড় ভোরবেলা মেয়েকে নিয়ে যাবি একন আর বিরক্তি করিস নি যা দিকিনি ।
যাচ্চি ঠাকুরমশাই । আমার মেয়েটাকে ভালো করে শুদ্ধি করে দিন যেন আর পাপের ভয় না থাকে মা মরা ঐ বোবা-কালা মেয়ে আমার ও ছাড়া আমার আর কে আচে বলুন এই বলে কেঁদে ফেলে নিতাই । ওরে বাপু তোর কোন চিন্তা নেই যজ্ঞ করলে আর কোন পাপ নাগবে না এবার তুই যা, আর হ্যাঁ আমার দক্ষিণা টা দিয়ে যা । নিতাই বলে কত দক্ষিণা ঠাকুরমশাই ? পাঁচশো এক ট্যাকা । এত ট্যাকা? আমি তো একন আনিনিকো ভোরবেলা এসে দিয়ে যাবো খন
তাই দিবি একন দূর হ দিকি ।
এই বলে চক্রবর্তী শিউলি কে নিয়ে ঘরে ঢুকলো । বোবা অসহায় মেয়ের সাথে সারারাত ধরে চললো পৈশাচিক অত্যাচারের যজ্ঞ । গভীর রাতে শিউলির বোবা কান্না কালপেঁচা ছাড়া শুনতে পেলনা কেউ । চক্রবর্তী তার লালসার যজ্ঞের আগুনে পুড়িয়ে মারছে শিউলির কুমারিত্ব, সতীত্ব । প্রায়শচিত্তের অত্যাচার আর সহ্য করতে পারলো না মেয়েটা ।
পরান পাখি ছটফটিয়ে মুক্তি নিল ঐ মুক্ত আকাশে । লজ্জা কপাটের রক্ত ধারায় ধুয়ে মুছে গেল শালগ্রাম শিলা ছোঁয়ার পাপ । ভোর বেলা নিতাই মেয়েকে নিতে এল ।সঙ্গে পাঁচশো টাকা দক্ষিণা । ঘরের পিতলের বালতি বেচে দিয়ে এনেছিল সেই পাঁচশো টাকা । চক্রবর্তীর বাড়ির বাইরে চেঁচিয়ে উঠলো নিতাই , ঠাকুরমশাই শিউলি কে নিতে এলুম গো । চক্রবর্তী বাইরে মুখ কাঁচুমাচু করে এসে দাঁড়ালো, বললো সবই তাঁর ইচ্ছা । আমাদের হাতে কি আর কিচু আচে রে । আমি চেষ্টা করেচিলুম মাত্র । কিন্তু নারায়নের রোষে পৃতিবী উল্টে যায় আর ও তো সামান্য মেয়ে মানুষ । নিতাই হকচকিয়ে বলে কে হয়েচে ঠাকুর মশাই ? আমার শিউলি মা কোতায় ?
চক্রবর্তী চোখ কচলাতে কচলাতে কান্নার ভান করে বললো ওরে তোর মেয়ে আর নেই নরায়নের কোপে ও পরলোকে গেচে । নিতাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ।
ওর কান্না শুনে গোটা গাঁয়ের লোক চক্রবর্তীর বাড়িতে হাজির । সবার মুখেই এক কথা কি করে মারা গেল শিউলি; চক্রবর্তী বললো বাপু তবু ভালো যে রোষ টা ওই বিটির ওপর দিয়ে গেচে । তা না হলে তো গাঁ শুদ্দু নোক মরতো গো । নিতাই ওঠ বাপ আর কান্না কাটি করিস নে সবই বিধাতার লিকন রে । যা লাশ টা নিয়ে বাড়ি যা আর যাবার আগে আমার দক্ষিণা টা দিস কিন্তু । যজ্ঞ সফল হয়নিকো তা বলে তো বামুনের দক্ষিণা টা মারতে পারিস না তাতে আরো অমঙ্গল হবে । নিতাই কান্না থামিয়ে বলে হ্যাঁ ঠাকুরমশাই এই নিন আপনার দক্ষিণা । ঘরের বালতি বেচে হাজার ট্যাকা পেয়েছিলুম । এই পাঁচশো এক ট্যাকা আপনার দক্ষিণা আর বাকি টাকায় মেয়ের দেহ টা সৎকৃতি করে দিই ।মা মরা বোবা মেয়ে টাকে কোনদিন কিচ্ছুটি দিতে পারিনিকো । একন একটু ভালো ঘী দিয়ে ওর সারা দেহটাকে মাকিয়ে একখানা তাজা ফুলের মালা দিয়ে ওকে চিতেয় তুলে পায়শচিত্তি করি ঠাকুরমশাই ।