ওয়েবডেস্ক – বৃষ্টির ঘাটতি জেরে জল কম পুকুরগুলিতে। জল নেই সেচ ক্যানেলগুলিতেও। একই চিত্র নদীগুলির ক্ষেত্রেও। গবাদি পশু ও খারিফ মরসুমে ধান চাষের জন্য বীজতলা তৈরি করতে জলধার দিকে তাকিয়ে গ্রামের মানুষেরা।
এ রাজ্যের চাষিরা সাধারণত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই আমন ধানের বীজতলা তৈরির কাজে হাত দেন। কিন্তু এ বার বাদ সেধেছে প্রকৃতি। প্রবল গরমে জলের অভাবে জেলার অধিকাংশ ছোট নদী এবং খাল এ বার শুকিয়ে কাঠ। ফলে, বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করতে পারছেন না চাষিরা। ফলে, এ বার আমন চাষের সময় পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে। কানা নদী, কানা দামোদর, দামোদর, মুণ্ডেশ্বরী, দ্বারকেশ্বরের মতো কয়েকটি নদী ডিভিসি-র জলে পুষ্ট হয়। সমস্যা মূলত এই নদীগুলিকে ঘিরেই। জেলার ১৮টির ব্লকের অনেকগুলি দিয়েই এই সব নদী বয়ে গিয়েছে। কিন্তু ডিভিসি-র জল না-মেলায় এই সব নদী শুকিয়ে গিয়েছে। ফলে, ওই নদীর জল বীজতলা তৈরির কাজে ব্যবহার করতে পারছেন না চাষিরা। ডিভিসি-র অনেক খালেরও ছবিটা একই।
ধনেখালির চেঁচুয়া গ্রামের চাষি শেখ মোমিন মণ্ডলের মাথায় হাত পড়েছে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কানা নদীতে জল নেই। মোমিনের খেদ, ‘‘আমরা ভাগচাষ বাদ দিয়ে কমবেশি পাঁচ বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করি প্রতিবার। নদীর পাড়ে বীজতলা করি। সেই কাজ সেরে জমির মাটি তৈরির কাজ করতে করতেই বর্ষা এসে যায়। তখন আর জলের সমস্যা হয় না। এ বার আমাদের এখানে নদীগুলির যা হাল, ৫০ বছরে এই পরিস্থিতি দেখিনি।’’ ওই ব্লকেরই আখনাপুরের চাষি অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নদী একেবারেই জলশূন্য হয়ে পড়ায়, এ বার চাষ অনেকটাই নাবি হয়ে গেল। বর্ষা ভাল মতো শুরু না হলে বীজতলার কাজে এ বার হাতই দিতে পারব না।’’
পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে এবং তা মোকাবিলায় অভিজ্ঞ চাষিদের নিয়ে জেলাস্তরের কৃষিকর্তারা শীঘ্রই বৈঠকে বসছেন। জেলার এক কৃষি আধিকারিক বলেন, ‘‘হুগলিতে নিম্ন দামোদর অববাহিকার চাষবাস অনেকটাই ডিভিসি-র জলাধারের উপর নির্ভরশীল। দামোদর-সহ অন্য ছোট নদী এবং খাল ডিভিসি-র জলেই পুষ্ট হয়। কিন্তু যেখানে জলাধারেই জল নেই, সেখানে একমাত্র পুরোমাত্রায় বর্ষা না-নামলে চাষ শুরু করার পরিস্থিতি আপাতত নেই। যে সব চাষি সেচসেবিত অঞ্চলে চাষ করেন, সেখানকার পরিস্থিতিও ভাল নয়। বৃষ্টি না-হওয়ায় মাটির নীচের জলস্তর হু-হু করে নামছে।’’
রাজ্যের মধ্যে হুগলি ও বর্ধমানেই সবচেয়ে বেশি ধান চাষ হয়। চাষে জলের আকালের শুরু গত মরসুম থেকেই। হিসাব অনুযায়ী গত বর্ষায় এ রাজ্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হয়। তার জেরে ডিভিসি-সহ সমস্ত জলাধারেই জলের পরিমাণ কমে। অনেক সময় এই রাজ্যে বৃষ্টিপাত কম হলেও পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টি হলে সেখান থেকে জল নেমে এসে এই রাজ্যের জলাধার ও নদীগুলিকে পুষ্ট করে। কিন্তু গত মরসুমে পশ্চিমবঙ্গের মতোই ঝাড়খণ্ডেও বৃষ্টিপাত কম হয়। তাই সব মিলিয়ে গত মরসুমে বোরো চাষের সময় রাজ্যের কৃষি দফতর জলের পর্যাপ্ত জোগান না-পাওয়া নিয়ে চাষিদের আগাম সতর্ক করেছিল। একই সতর্কবার্তা ছিল আলু চাষের ক্ষেত্রেও। কিন্তু সেই সতর্কবাণী উপেক্ষা করে ভাল আলু ফলান হুগলির চাষিরা। যদিও অকাল বৃষ্টির জন্য গত মরসুমে আলু থেকে লাভের কড়ি ঘরে তুলতে পারেননি চাষিরা।
এ বার সেই জলের প্রশ্নই ফের বিঁধছে রাজ্যের চাষিদের। তাঁরা এখন আকাশের দিকেই তাকিয়ে।
মন্ত্রী জানান, সেচ ক্যানাল মজে গিয়েছে বলে বেশ কিছু অভিযোগ ছিল চাষিদের। মেদিনীপুর ও বাঁকুড়ায় সেই সেচ ক্যানালগুলি সংস্কারের কাজ হচ্ছে।
এ দিকে জলের জন্য এ বার বোরো চাষে নামতে পারেননি দক্ষিণ বাঁকুড়ার বহু চাষি। তাঁরা জানাচ্ছেন, অন্য বছর রবি শষ্যের জন্য জানুয়ারিতেই এক বার কংসাবতী থেকে জল দেওয়া হত। সেই জলেই চাষিরা বোরোর বীজতলা করতেন। কিন্তু এ বার সে ভাবে বৃষ্টি হয়নি। সেচ ক্যানালেও জল পাওয়া যায়নি। ফলে, বোরো চাষ মার খাচ্ছে।
সিমলাপালের কুকরাকন্দর এলাকার চাষি আজিত মাহাতো, রানিবাঁধ অম্বিকানগরের তপন মাহাতো বলেন, ‘‘পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়া আমন চাষেও পর্যাপ্ত ফলন হয়নি। এ বার বোরো চাষও মার খাচ্ছে। আমরা খুব সমস্যায় পড়ে গিয়েছি।’’ সিমলাপালের দুবরাজপুরের শঙ্কর ঘোষ, বলেন, ‘‘আমি পাঁচ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করতাম। এ বার এক কাঠা জমিতেও চাষ করা সম্ভব.হচ্ছে না সেচের জলের অভাবে।’’
বোরো চাষ যে এ বার মার খাচ্ছে, সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন খাতড়া মহকুমা কৃষি আধিকারিক গণেশ সিং সর্দার। তিনি বলেন, ‘‘খাতড়া মহকুমা এলাকায় প্রতি বছর সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হত। কিন্তু, গত সপ্তাহ পর্যন্ত যা খবর পাওয়া গিয়েছে, তাতে এ বার বোরো চাষ আদৌ করা যাবে কি না, ঘোর সংশয় রয়েছে। যেটুকু এলাকায় চাষ হচ্ছে, তা কোনও হিসাবের মধ্যেই আসছে না।’’
সেচমন্ত্রীর সঙ্গে এ দিন ছিলেন রানিবাঁধের বিধায়ক জ্যোৎস্না মান্ডি ও খাতড়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জয়ন্ত মিত্র।